পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
কাজী নজরুল ইসলামের লিচু চোর ছড়ার মতোই শেষ পর্যন্ত ফারুক হোসেন প্রাণ দিল মগবাজার জামায়াত অফিসের কাছে গিয়েই। লাশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ট্রাজেডির নায়ক হয়ে মায়ের বুক খালি করে চলে গেলেন ফারুক হোসেন। তার মৃত্যুতে হত্যামামলার আসামী হিসেবে জামায়াত নেতৃবৃন্দের রিমান্ড চলছে এখন।
হরতালের পূর্ব রাত। সারাদেশে টানটান উত্তেজনা। কি হয় কি হয়, কি জানি কি হয়। সবার মনেই আশংকা ছিল প্রতিহিংসার রাজনীতিতে অভ্যস্ত আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের এ হরতালকে কিছুতেই সহজভাবে মেনে নেবে না। আমি নিজেও হরতালের আগের রাতে অর্থাৎ ২৬ জুন ২০১০ তারিখ সন্ধ্যায় ফেসবুকে স্টাটাস দিয়েছিলাম, “হরতালকে ধ্বংসাত্মক প্রমাণে আওয়ামী লীগ রাতের আধারে অগ্নিসংযোগ ও বোমাবাজী করতে পারে। বিগত আমলে বিআরটিসি বাসে গানপাউডার ঢেলে গণহত্যার যে নজীর তারা রেখে গেছে তা আবারো করতে পারে বিরোধীদের ফাঁসাতে। তাই হুশিয়ার”। আশংকা যে একেবারেই অমূলক ছিল না, হরতালের আগের সন্ধ্যায় বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীরা ঠিকই অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আতংকিত করে তোলে। এর আগেই হরতাল যে কোন মূল্যে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল ছাত্রলীগ। সবার আশংকাকে সত্যে পরিণত করতে আওয়ামী লীগের অংগ সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ দেশব্যাপী নারকীয় তান্ডব চালিয়ে যে বর্বরতার নজীর স্থাপন করেছে তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল।
তবে এবার মেঘ না চাইতেই জল মেলে আওয়ামী লাশের রাজনীতিতে। এ কথা বহু পুরণো যে, আওয়ামী লীগ যে কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে লাশের খেলাটাকেই প্রাধান্য দেয়। একটা লাশের বদলে দশটা লাশ ফেলে দেয়ার শেখ হাসিনার রণ হুংকার এখনো সাধারণ মানুষের কানে বাঁজে। সময় পাল্টে, তবু আওয়ামী লীগের রাজনীতির কৌশল বদলায় না। অতীতেও নীরিহ মানুষদের প্রাণের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতারোহণে নির্দয় হয়েছে, এমনকি বুকে পিঠে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তিপাক” বাণী লিখে রাজপথে প্রাণ দিয়েছিল যে শহীদ নূর হোসেন, অনেকেরই অভিযোগ শেখ হাসিনার নির্দেশে রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত করতেই নূরহোসেনকে বলি দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবার লাশের রাজনীতির বলি হলেন অটোমোবাইল মেকানিক ফারুক। গতকাল সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ ছিল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ১৬ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুরের চাঞ্চল্যকর সংবাদ। অথচ টিভি চ্যানেল গুলো সরকারী রক্তচক্ষুর ভয়ে এ সংবাদটি এড়িয়ে বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন ফারুক হোসেনের সাথে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎটাকেই প্রাধান্য দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। শেখ হাসিনা ফারুকের মা’কে জড়িয়ে ধরে যে মায়াকান্নার অভিনয় করলেন তাতে অনেকের হৃদয় আর্দ্র হলেও আমার মন অশুভ ভয়ে ছেয়ে যায়। বলতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই আমি শেখ হাসিনার মুখায়বে জমের প্রতিচ্ছবি দেখি। আমার আশংকা হয়েছে, ফারুকের অন্তিম মুহূর্ত বুঝি ঘনিয়ে এল। ঠিক এ আশংকাকে সত্যে পরিণত করে সকালে শীর্ষনিউজ ডটকমে সংবাদ প্রকাশিত হলো “অগ্নিদগ্ধ ফারুক মারা গেছেন”।
এবার আসুন হরতালের আগের রাতের একটি সংবাদের অংশ বিশেষ পড়ে দেখি:
“পল্টন থানা এলাকার ৩/৩, বিজয়নগর টেন ইয়ার্স প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়কে রাত পৌনে ৮টায় ৭/৮জন ব্যক্তি একটি প্রাইভেট কারে (ঢাকা মেট্রো খ-১১-৪০৮৪) পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ওই স্থানের টহল পুলিশের একটি দল ৫ ব্যক্তিকে আটক করে। আটককৃতরা হলেন, মোঃ মাঈনউদ্দিন আহমেদ (৩৮), এমরান খান (২৫), জহিরুল হক (২৮), মাইনুল ইসলাম টিটু (৪২) ও নাসিম (৪০)। তাদেরকে আসামী করে পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নম্বর- ৩৪ (২৬/০৬/২০১০ইং)। এছাড়াও রাত সাড়ে ৮টায় মগবাজার টঙ্গী ডাইভারশন রোডে একটি প্রাইভেট কারের (ঢাকা মেট্রো ক-০৩-৯৩৭১) সিলিণ্ডার বিস্ফোরণে আগুন লেগে তিন জন আহত হয়েছে। আহতরা হলেন, অটোমোবাইল মেকানিক ফারুক (৩০), সুমন (৩০) ও ফয়সাল (২৮)। জানা যায়, আহতরা সবাই অটোমোবাইল মেকানিক। তারা মিরপুরে একটি গাড়ি মেরামত করে ধোলাইখালে ফিরছিল। পথিমধ্যে মগবাজার রেলগেট পার হওয়ার পর চা পান করতে গাড়িটির গতি কমায়। সেসময় পেছনে সিলিণ্ডার ফেটে যাওয়ার শব্দ পায় এবং গাড়িতে আগুন ধরে যায়। আগুনে ফারুকের সারা শরীর অগ্নিদগ্ধ হয়। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। আহত সুমন শীর্ষ নিউজ ডটকমকে জানায়, গাড়ির গতি কমানোর পর পরই একটি শব্দ হয় এবং আগুন ধরে যায়। রমনা থানার এসআই সোবহান শরীফ শীর্ষ নিউজ ডটকমকে জানান, গ্যাস সিলিণ্ডার লিক করে গাড়িটিতে আগুন ধরে গেছে।
এবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন, যে প্রাইভেট কারটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন ধরে গেল, নিছক একটি অগ্নিদূর্ঘটনায় প্রাণ হারালো ফারুক হোসেন তাকে কত সহজেই অন্য মামলার সাথে জড়িয়ে ফেলা হলো। পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে পল্টন থানা এলাকায় আর ফারুক হোসেনের গাড়ীর সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হল রমনা থানা এলাকায়। অথচ দুটো ঘটনার একটির সাথে আরেকটির জোড়াতালি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ফারুক হোসেনকে হত্যা করা হলো। আশংকা হচ্ছে এ ধটনার প্রত্যক্ষদর্শী, অপর আহত অটোমেকানিক সুমন ঘৃণ্য লাশের রাজনীতির বলি না হয়। অনেক কিছুই জানে সে, অনেক কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী সে, তাকে কি বাঁচতে দেবে বাকশাল?
যারা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে লেখাটি পড়েছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, নীচের অডিওটি ভালো করে শুনুন। ২০০৪ সালের ৪ জুন হরতালের কয়েক ঘন্টা আগে আওয়ামী যুবলীগ সভাপতি ও বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের নেতৃত্বে ঢাকা শেরাটন হোটেলের সামনে যাত্রীবোঝাই বিআরটিসি বাস গান পাউডারে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সেদিন আওয়ামী পশুদের বিষ নিঃশ্বাসে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়েছিল দু’বছরের শিশুসহ এগারজন। এভাবেই কি লাশের রাজনীতির হাতে জিম্মি হয়ে থাকবে বাংলাদেশ? এভাবেই কি বাকশালী রক্ষীবাহিনীর নির্মমতায় কাছে হেরে যাবে বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষ?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


