সঠিক সচেতনতা (Right consciousness) শুধু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যই নয়, সমাজের সকল ধরনের সমস্যা নিরসনেও সঠিক সচেতনতা গড়ে ওঠা জরুরী। তবে শ্রেণী বিপ্লবের ক্ষেত্রে যেমন পুঁজিবাদের বিভিন্ন কলাকৌশলের জন্য যেমন সঠিক সচেতনতা ভুল সচেতনতার (False consciousness) মধ্যে ঘুরপাক খায়, ঠিক তেমনি রাষ্টযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি ও সেই দুর্নীতির জায়েজীকরণ যখন সামাজিকভাবে করা হয় তখন সমাজের বাসিন্দারাও ভুল সচেতনতার ঘুরপাকে ঘুরপাক খায়। জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির ফলে সমাজের বাসিন্দাদের মাথায় ভুল সচেতনতাটাই সঠিক সচেতনতা বলে স্থান পায়। আসলে সঠিক সচেতনতার ধারেকাছেও তাদের চিন্তা পৌঁছতে পারে না।
টাকা খেয়ে জননিরাপত্তায় নিয়োজিত এলিট বাহিনীর দ্বারা জনসাধারণকেই গুম, অপহরণ ও হত্যা, দলীয় কোন্দলে একজন আরেকজনকে প্রকাশ্যে গুলি করে এবং জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা, অন্যায়ভাবে রাস্তা থেকে মানুষ ধরে মাত্র এক হাজার টাকার জন্য পুলিশ দ্বারা পিটিয়ে হত্যা করা, প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়া, চাকুরীর ক্ষেত্রে একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগে মোটা অংকের ঘুষ বাণিজ্য, সরকারি অফিসে যতবার ফাইল হাত ঘুরে ততবার ঘুষ লেনদেন ইত্যাদি ইত্যাদি কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা! মোটেই নয়। রাষ্টযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি, বিচার ব্যবস্থা ইচ্ছেমত পরিচালনা ইত্যাদির অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিশেবেই এসব অনিয়ম সমাজে প্রকট থেকে প্রকটতররুপে দেখা দিচ্ছে।
সত্য ও ন্যায়ের পরিবর্তে যখন অন্যায় ও অবিচার সমাজে বিরামহীন ভাবে চলতে থাকে তখন একসময় ওই অন্যায়, অবিচারই সমাজে সত্য-সঠিক-ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠা পায়। অন্যায়কে তখন আর অন্যায় বলে মনে হয় না। অন্যায় করলে যে একজন সুস্থ মস্তিস্কের বিবেকবান মানুষের পরে সামান্য হলেও মনে অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হয়, অন্যায়ের মহাসমারোহ চলা সমাজে সামাজিকভাবে অন্যায় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে সেটাও ব্যক্তিমানুষের মনে জাগ্রত হয় না। এটা এমনই একটা পদ্ধতি যে পদ্ধতির চক্রে মানুষের সুকোমল সুকুমার বৃত্তিগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। যেটাকে বলা যায়, ক্রমাগত মিথ্যার চাপে পিষ্ট হয়ে একসময় সত্যটারই অপমৃত্যু হওয়া।
একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি পরিস্কার করা যাক। পড়াশোনা শেষ করার আগেই অনেককে বলতে শুনছি যে তারা তিন লাখ থেকে দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকুরী নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। চাকুরী পেতে হবে ঘুষ দিয়ে! ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে কত বড় একটি জঘন্য চিন্তা ও কাজ! কিন্তু তা সত্বেও কতটা আত্মবিশ্বাস ও অবলীলায় এ কথা তারা বলে বেড়ায়! তারা বলছে বলেই কি তাদের দোষ দেয়া যায়? কখনও না। এটা তো এখন সিস্টেমই হয়ে গেছে। যা ন্যাচারাল, স্বাভাবিক। এখন কেউ চাকুরীর খবর অন্যদের জানালে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে সেটা হল, 'কত লাগলো।' তার মানে ঘুষ ছাড়া যে চাকরি হয় না তা সবাই জানে এবং এটা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এতে কেউ কিছু মনে করে না। আর নীতি নৈতিকতা ও ধর্মীয় দর্শনের কথা বলছেন! পেট ও প্রয়োজনের চেয়ে বড় নীতি-নৈতিকতা-ধর্ম আর দ্বিতীয়টি নেই।
এবার আসি কাঠামোগত চক্রে ভুল সচেতনতা ও ভুল চিন্তাভাবনার কথা। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বহুদিন ধরেই হচ্ছে। কাজের কাজ তেমন হচ্ছে না। জাফর ইকবাল স্যারও বিষয়টি নিয়ে লিখে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। তাতেও তেমন কাংখিত ফলাফল আসছে না। চলতি এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তুলকালাম কাণ্ডকারখানা চলছে। এরই মাঝে শুনছি বুয়েটের ছাত্রছাত্রীরা এক অদ্ভূত, উদ্ভট দাবি তুলেছে। তাদের দাবি এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যেন বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা না দিতে দেয়া হয়। আমি জানিনা কতটা অবিবেচনাপ্রসূত চিন্তাভাবনা থেকে তাদের এ দাবি। এখন যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে তারা কি প্রকৃতপক্ষে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী? না, তাদেরকে কখনোই দায়ী করা যায় না। তারা ভিকটিম। প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী সিস্টেম তথা রাষ্ট্রযন্ত্র। এখানে শিক্ষার্থীদের দোষ দিয়ে বা তাদেরকে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে কোনো লাভ হবে কি? বুয়েট, ঢাবি, জাবি, রাবি, চবিসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে এদেরকে ভর্তি না করলে কি প্রশ্ন ফাঁস হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে? তবে বুয়েটিয়ানদেরও লাভ নেই। কারণ ওই যে সামাজিক কাঠামোবদ্ধতায় ভুল সচেতনতার দৌরাত্ম্য। অনেকে আবার দাবি তুলেছেন হয়ে যাওয়া পরীক্ষাই বাতিল করার জন্য। এ দাবিটিও যথেষ্ট বিবেচনাপ্রসূত নয়। পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর পরীক্ষা বিশেষ করে একাডেমিক পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেয়া সত্যিই দুঃস্বাধ্য। উচিত ছিল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের খবর পাওয়া মাত্র পরীক্ষা বাতিল করা। এখানেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রীর চরম ব্যর্থতা। সবাইকে মনে রাখতে হবে আমাদের দাবি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা, পরীক্ষার্থীদের শায়েস্তা করা নয়।
জাফর ইকবাল স্যার একজন শিক্ষাবিদ। আমাদের অনেকের কাছেই একজন আদর্শ মানুষ ও শিক্ষক। শিক্ষার সাথে স্যারের সম্পৃক্ততা বেশি বলেই শিক্ষার অবক্ষয় স্যারকে অধিক ব্যথিত করে। তবে তাই বলে যে দেশের অন্যান্য আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে স্যারের ভাবনা একেবারেই নেই তা আমি বিশ্বাস করি না। নোংরা রাজনীতির দুর্গন্ধ থেকে যতটা নিজেকে দূরে রাখা যায় স্যার বুঝি সেই চেষ্টাই করেন। কিন্তু সেটা যাই হোক দেশের যে কোনো ঘটনায় আমরা সবাই সমানভাবেই প্রভাবিত ও আক্রান্ত হই। স্যারকে বিনয়ের সাথে জানাতে চাই, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি জিইয়ে রেখে সেখান থেকে শুধুমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে টেনে বের করে আনা কোনোদিনই সম্ভব নয়। সে আপনি, আমি, আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন। সমাজের প্রত্যেকটি ঘটনা, দুর্নীতি, অবিচার, অনিয়ম একটি অপরটির সাথে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অনিয়মের মধ্যে থেকে বের করে আনা কেবল কল্পনায়ই সম্ভব, বাস্তবে নয়। স্যারের কাছে অনুরোধ থাকবে আমাদেরকে পথ দেখানোর জন্য। লিখে আমাদেরকে সচেতন করার জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। কারণ, ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া দেশটাকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এখনই রুখে দাঁড়ানোর বিকল্প যে আর নেই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




