আলম সাহেবের বয়েস হয়েছে।
সরকারী চাকুরে ছিলেন, অবসর নিয়েছেন অনেক বছর আগেই। চোখের সামনে একমাত্র ছেলেটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে। আলম সাহেবের স্ত্রী নিজের স্বাধ্যের মধ্যের সবটুকু দিয়ে মোটামুটি ধুমধাম করেই ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। নিজের অল্প-স্বল্প সমস্ত গহনা বৌমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন।
আলম সাহেব সারা জীবন সৎ ছিলেন বলে তার সম্পদ ছিলো না। কোনো রকমে ঢাকায় একটি বাড়ি তৈরি করতে পেছিলেন। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটু খোলা যায়গা। ইচ্ছে ছিলো বৃদ্ধ বয়সে বুড়বুড়ি মিলে নাতি-নাতনিদের নিয়ে এখানে বসে খেলা করবেন, সময় কাটাবেন। তিনি বুড়ো হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বুড়ী আর নেই। হঠাত করেই কেয়েক বছর আগে উনাকে একা ফেলে পরপরে পারি জমিয়েছেন।
আলম সাহেবের ছেলে তারই মত সহজ সরল ভালো মানুষ, বাবার আদর্শেই মানুষ হয়েছে। আলম সাহেব যেমন তার স্ত্রীকে অন্তরের সবটা দিয়ে ভালোবাসতেন, তার ছেলেও তার স্ত্রীকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। এতোটাই ভালোবাসে যে বউয়ের কথার উঠে-বসে। তাতেও কোনো সমস্যা ছিলো না। সমস্যা হচ্ছে কিছুদিন হলো তার বৌ বারবার বলছে বুড়ো আলম সাহেবকে তিনি আর পালতে পারবেন না। আলম সাহেবকে কোনো একটি বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে। আলম সাহেবের ছেলে বাধ্য-স্বামীর মতো বৌয়ের নির্দেশে বৃদ্ধ বাবাকে একটি বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে যায়।
বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পৌছে দিয়ে আলম সাহেবের ছেলে যখন নিজের বাড়িতে ফিরে আসছে। তখন তার স্ত্রী কল করে বলে, সে যেনো বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজারকে বলে আসে ঈদ-পূজ-পার্বনের ছুটিতে তারাই আলম সাহেবের সাথে দেখা করতে আসবে। আলম সাহেবকে যেন কখনোই বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া না হয়। স্ত্রীর কথা মতো আলম সাহেবের ছেলে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার পৌছে যায় বৃদ্ধাশ্রমে। সে দূর থেকে দেখে তার বাবার সেখানকার বুড়ো ম্যানেজারের সাথে খুব আনন্দ নিয়ে পূর্বপরিচিত বন্ধুর মতো কথা বলছেন। খুব পরিচিত কেউ না হলে এই ভাবে আনন্দ নিয়ে আলম সাহেব কারো সাথে কথা বলতে পারে না।
কিছুক্ষণ পরে আলম সাহেব তার ঘরে চলে গেলেন। তখন আলম সাহেবের ছেলে এসে ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইলো তার বাবার সাথে ম্যানেজারের পূর্বপরিচয় ছিলো কিনা। তখন ম্যানেজার জানালো। অনেক অনেক বছর আগে তিনি যখন যুবক ছিলেন তখন তিনি একটি অনাথাশ্রমের ম্যানেজার ছিলেন। তখন নিঃসন্তান আলম সাহেব একটি দুধের শিশু ছেলেকে তাদের কাছ থেকে দত্তক নেন। তখন থেকেই আলম সাহেবের সাথে তার পরিচয়।
ভালো মানুষ আলম সাহেবের সেই দত্তক নেয়া ছেলেটি এখন ম্যনেজারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে!
(মিরাক্কেলের একটি কৌতুক থেকে নেয়া)
এবার একটি গান নচিকেতার -
ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার
ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার
নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী
সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি
ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!
আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না
ওসব নাকি বেশ পুরনো, ফ্ল্যাটে রাখা যায় না
আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না
ওসব নাকি বেশ পুরনো, ফ্ল্যাটে রাখা যায় না
ওর বাবার ছবি ,ঘড়ি-ছড়ি, বিদেয় হলো তাড়াতাড়ি
ছেড়ে দিলো, কাকে খেলো, পোষা বুড়ো ময়না
স্বামী-স্ত্রী আর আ্যালসেশিয়ান- জায়গা বড়ই কম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!
নিজের হাতে ভাত খেতে পারতো নাকো খোকা
বলতাম আমি না থাকলে কি করবি বোকা?
ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো খোকা আমার কথা শুনে
খোকা বোধ হয় আর কাঁদে না, নেই বুঝি আর মনে
ছোট্টবেলায় স্বপ্ন দেখে উঠতো খোকা কেঁদে
দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে
দু’হাত আজো খুঁজে, ভুলে যায় যে একদম
আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম!
খোকারও হয়েছে ছেলে, দু’বছর হলো
তার তো মাত্র বয়স পঁচিশ, ঠাকুর মুখ তোলো
একশো বছর বাঁচতে চাই এখন আমার সাধ
পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট।
আশ্রমের এই ঘরটা ছোট, জায়গা অনেক বেশি
খোকা-আমি দু’জনেতে থাকবো পাশাপাশি
সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণ রকম
মুখোমুখি আমি, খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:০১