ব্যাপারটা কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে।
রুমানার দেশে ফেরাটা সুফিয়া কামালের জন্মদিবসে আমাদের জন্য কোন উপহার নয় ; কিন্তু আমাদের অন্ধত্বকে নাড়িয়ে দেয়া এক ঘটনা।
সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন নারী জাগরণের জন্য। নারীর ক্ষমতায়ন কাগজ-পত্র কিংবা অফিস বা রাজনৈতিকভাবে হয়েছে কিন্তু নারী জাগরণ হয়নি আমাদের মনমানসিকতায়। দেশের প্রতিনিধিত্বকারী এক মেধাবী আলোকিত মুখ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক একটি প্রাণী কর্তৃক আক্রান্ত হবার পর সে কেন আক্রান্ত হল তা নিয়ে রয়েছে অসীম আগ্রহ কারণ সে নারী। তার বিচার হবার জন্য যেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা কমিশনার কর্তৃক চারিত্রিক সনদপত্র প্রদান অতীব জরুরী হয়ে পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীরা এবং রুমানার পরিচিত জনরা জানেন রুমানা কেমন ছিল। অথচ কিছু মানুষ প্রশ্ন করে বসল "রুমানা কেমন টাইপের মেয়ে"? চোখ হারানো, নাক খাবলিয়ে ওঠানো তাদের পীড়া দেয় না। থাকতে না পেরে কানাডা থেকেও তার সাথে এহেন আচরণের প্রতিবাদ আসতে লাগলো।
যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হতোনা। তিনি তাঁর মা সাবেরা বেগমের কাছে বাংলা পড়তে শেখেন। মাত্র বার বছর বয়সে তাঁকে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সাহিত্যপাঠে উৎসাহিত করেন। আর বিপরীতভাবে আমরা দেখতে সাঈদ হাসান এবং তার সমমনাদের কুৎসিত মুখ যারা নারীরা উচ্চশিক্ষিত হবে তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। এখন পুরুষদেরই সুশিক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বিরুদ্ধবাদীরা তেড়ে আসবেন যে, সাঈদ পড়তে না দিলে রুমানা বিদেশ গেল কিভাবে? কিন্তু তারা জানবে না, রুমানা আরো আগে যেতে পারতেন বিদেশে পড়ার জন্য। স্বামী-সন্তানের কথা ভেবেই যাননি। আর রুমানা তার নিজস্ব প্রচেষ্টাতেই কানাডার প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। স্বামী সন্তানের জন্য থিসিস পেপার জমার সময় বাড়িয়ে এসেছে দেশে তাদের সাথে সময়টা কাটাবার জন্য।
স্বামী কাছে এসে রুমানা হারিয়েছে তার একটি মূল্যবাদ সম্পদ - দৃষ্টশক্তি। এখন পর্যন্ত রুমানার চোখে দেখার কোন সম্ভাবনা শোনা যায়নি। বাম চোখেতা এমনভাবে ফাটিয়ে গলিয়ে দিয়েছে যে ওটা দিয়ে দেখার কোন সম্ভাবনা নেই। আরেকটি চোখে সম্ভবনা নেই তবে কর্ণিয়ার সাথে সংযোগ কিছুটা আছে। ওখানকার জমাট রক্ত আস্তে আস্তে সরে যাবার পর বোঝা যাবে ওটা দিয়ে দেখার কোন সম্ভাবনা আছে কি-না? রুমানা যদি আলো / আঁধারের উপস্থিতি বুঝতে পারতেন তবে দেখার সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু তিনি তা বুঝতে পারছেন না। তাই তার চোখটা যে ভাল হবে সে ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করা যাচ্ছেনা।
তবে তার অন্ধত্ব চোখ খুলে দিয়েছে সমাজের অন্ধত্বের। আমরা যা যা দেখতে পেয়েছি তা হল:
১। পুলিশ নিপীড়ককে খুজে পায়না। এমন একটি নিরাপদ স্থান আমাদের দেশ।
২। হাইকোর্টের নির্দেশ দেবার পর পরই পুলিশ খুজে পায় অপরাধীকে।
৩। আটক হবার পর দোষী ব্যাক্তির মিথ্যা/ বানোয়াট গল্পে সহজেই অনেকের মন গলে যায়। দোররা বা মাটিতে পুতেঁ পাথর নিক্ষেপের চেয়ে চোখ ওঠানোকে কম শাস্তি বলে মনে করে তারা।
৪। মেয়েদের চরিত্রের ব্যাপারটি যেন বেশ সস্তা। একজন বললেই হল, অমুক মেয়েটা না... ... ... ...। ব্যাস, এবার লাগো তার চরিত্রের পেছনে, সে যত ভালভাবেই জীবনযাপন করুক না কেন।
৫। কারো কাছে এটি স্বামী-স্ত্রীর ব্যাক্তিগত জীবনের ঘটনা।
৬। পারিবারিক নির্যাতন একটি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। এটা নিয়ে এতো আহামরির কিছু দেখছে কারো কারো চোখ।
৭। কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য। দরিদ্র হলে এমন প্রচারণা পেত না।
৮। সরকার বা বিরোধী দলীয় কেউ তার নিজের দলের কেউ আক্রান্ত না হলে কোন আগ্রহ দেখায়না।
৯। রাজকার কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের হ্ত্যা / নির্যাতনে এ দেশীয় মানুষরা সহযোগিতা করেছিল। হাসান সাঈদের মতো লোকেরা বুদ্ধিজীবীদের অন্ধ করে দেয়ার জন্য এখনো সচেষ্ট। সচেষ্ট দেশের মেধাকে নষ্ট করে দেয়ার জন্য।
রুমানার চোখে আক্রমণ শুধু তার চোখে আক্রমণ নয়। সেটি আমাদের সমাজের চোখকেও আক্রমণ। আমাদেরকে দেখার জন্য আমাদের চারপাশে অসংখ্য হাসান সাঈদ আছে যারা সুযোগ পেলে উঠিয়ে নিতে পারে আমাদের দৃষ্টিশক্তি। অন্ধ করে দিতে পারে অনায়াসেই। বেগম রোকেয়া কিংবা সুফিয়া কামাল ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন সমাজসেবী ও নারী নেত্রী। সুফিয়া কামালের জন্মবার্ষিকীতে তার লেখা পড়ে নারী জাগরণের ব্যাপার ধের্য্য হয়েতো আমাদের নেই। তবে আপনাদের নিজস্ব স্মৃতিচারণ থেকে স্কুল সময়ে পড়া কিছু ভাব সম্প্রসাণের উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছি। একটু ভেবে করুন ভাব সম্প্রসারণ। আসলেই কি এগুলো আবার পড়ার বা শেখার বা তাদেরকে শেখানোর সময় হয়েছে নয়কি?
"অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে"
"প্রাণ থাকিল প্রাণী হয় কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না"
"তরুলতা সহজেই তরুলতা,
পশুপাখি সহজেই পশুপাখি,
মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবেই মানুষ"
"চোরে না শুনে ধর্ম কাহিনী।"