somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাইমারির মাস্টার - ২

১৪ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২০১৬ সাল পর্যন্ত আমার মতো লক্ষ্যহীন মানুষের লক্ষ্য ছিলো শুধুই জীবন যাপন করা। তার জন্যে একটি সহজ চাকরি সাথে কিছুটা সম্মান হলে মন্দ হবেনা। এরপরেই আমার জীবনে ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা। আমার বন্ধুরাও আমাকে খুব বাস্তব চিন্তাধারার এক হার্টলেস মানুষ হিসেবেই জানতো। কিন্তু যেদিন মফিজ স্যার মারা গেলেন আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। তখন আমার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সামনে নোভেল পরীক্ষা। কিন্তু আমার সাথেই উপন্যাসের মতো ঘটনা ঘটে গেলো। আমি আমার জীবনে কোথাও কোন গ্রহনযোগ্যতা পাইনি। মনে হতো আমি যেন এক্সিস্টই করিনা। স্যার আমার খুব ভেতরে জায়গা নিয়ে নিয়েছিলেন। সময় করে খবর নিতেন আর বলতেন, You are not done yet Idiot. তুই অনেক ইনফ্লুয়েনশিয়াল। তোর আশেপাশের মানুষগুলো তোর কারনেই ভাল থাকবে।

আমি নিজেকে আয়নায় দেখে থমকে যাই। ভোরে স্যার কে ওরা নিয়ে যাচ্ছিলো। কফিনে সাদা কাপড়ে মোড়া । জানাজা হচ্ছিলো। আর আমি দূর থেকে একটা ঘোরের মতো দেখে যাচ্ছিলাম। অনেক ঘটনা মনে হয় যেন কয়েক সেকেন্ডে ঘটেছিলো। আমার কান্না দেখে আমার বন্ধুরা কি করবে বুঝতে পারছিলো না। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। জানাজার পরে হঠাৎ আমার খেয়াল হলো, চারদিকে কতো মানুষ, কতো ছাত্র ছাত্রী, সবার চোখ ভেজা। সিনিয়র আপু,ভাইয়ারা যাদেরকে আমি এড়িয়ে যেতাম মুখচোরা স্বভাবের কারনে তারাও আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাসায় ফিরলাম। ফিরতেই হতো,পরীক্ষা কাল।

স্যারের জানাযায় গিয়ে আমার শিক্ষক হবার যে ভূত মাথায় চেপেছিলো তা ব্রহ্ম দৈত্যে রুপান্তর হলো। এতো মানুষ, এতো সন্তান, আহ! What a life! মৃত্যু নিয়ে আমি বরাবরই রোমান্টিক। আমার শেষকৃত্যে এতো সন্তান থাকবে ভেবে আমার লোভ হলো। এর শেষ পরিণতি হলো আমার এই পেশাতে আসা।

পরীক্ষা থেকে জয়েনিং পর্যন্ত সময়টা অনেক দীর্ঘ এবং অনিশ্চিত ছিলো। রীটের কারনে আমরা জয়েন করতে পারিনি। অনেক হাইকোর্ট, উকিল, জেলা ভিত্তিক কাউন্টডাউন শেষে জয়েন করতে পারলাম। কিন্তু তিনদিন ক্লাস করার পরই করোনা হানা দিলো। শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ হলো, অনলাইনে সম্ভপর হয়নি বিধায় মোবাইল ফোনে পাঠদান চলতে লাগলো। অনেক অনলাইন মিটিং হলো, ট্রেনিং হলো ঘরে বসে। সরকার আমাদের বেতন ভাতা বন্ধ করলেন না। তাতে করে জনসাধারণের পাশাপাশি নিজেদের উর্ধতন কর্মকর্তা সহ সিনিয়র শিক্ষকরাও " বসে খাচ্ছি" তকমা দিলেন। তাদের পাশাপাশি আত্মীয়রা এলাকার সদ্য চাকরি পাওয়া বড় ভাইয়েরা খুব ঈর্ষান্বিত হলেন। অথচ আমরা বিস্কুট বিতরণ সহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যহত রাখলাম। আমি সহ অনেক শিক্ষক শিক্ষিকার পাঠদানের জন্য কিছু কিছু বাড়িতে যেতে হলো। কেননা ক্যাচম্যান্ট এরিয়ার সুবিধা বঞ্চিত কিছু শিশুদের অভিভাবকদের মোবাইল ফোনই নেই। ফোন করলেও কেউ কেউ দোকানে থাকেন পরে বলে দেবেন বলেন, কেউ কেউ রং নাম্বার বলে বকে দেন, কেউ কেউ ধরতে চান না , বিস্কুট কবে দেবে জিজ্ঞেস করেন । কিন্তু কেউ কেউ খুব আগ্রহী ছিলেন বটে।

প্রথম বেতনের জন্য কাজ করতে গিয়ে টের পেলাম যে সম্মানের জন্য এই পেশা আমার ভেতরে এতো জায়গা নিয়েছে সেই সম্মানটুকু আসলে কালেভদ্রে অভিভাবকদের থেকে পাওয়া যায়। অফিস, শিক্ষকদের উপদ্রবের মতই মনে করেন। কিছু টাকা পকেটে ঢুকার সমূহ সম্ভাবনায় তাদের চোখ চকচক করতে থাকে। অনেকে ভুলবশত (নাকি ইচ্ছে করেই) কম্পিউটার অপারেটরকেই স্যার বলে ফেলেন। তাদের শিক্ষকদের সাথে করা ব্যবহার গুলো যেকোন নতুন শিক্ষককেই তাদের এই ডিপার্টমেন্টে নিজস্ব অবস্থান সম্পর্কে স্পস্ট ধারণা দেয়। আমি জীবনে কোনদিন আমার কোন কাজে স্পিডমানি দেয়ায় বিশ্বাস রাখিনি, লাইন ভাঙ্গিনি , আমাকে দেরী করেই সবকিছু পেতে হয়েছে। ভোগান্তি হয়েছে অনেক। কিন্তু এ যাত্রায় অরাজকতায় সামিল হতে হলো।উল্লেখ্য, প্রথম বেতন পেতে অফিস থেকে বিলের কাগজ নিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়ে আসতে হয়েছে কেননা করোনায় অফিস থেকে পাঠানোর জন্য কেউই যেতে আগ্রহী ছিলেন না। প্রায় ২৭ কি মি সাইকেল চেপে, লক ডাউনে যানবাহনের অভাব থাকায় স্কুল এরিয়ার লাগোয়া ব্যাংকে যেতে হয়েছে। তারপরেও কাজ আটকে ছিলো।

অবশেষে উপলব্ধি হলো যে, তাহলে বোধয় জীবনের প্রথম বেতন পেতে উৎকোচ দিয়েই আমার ঘটনাবহুল শিক্ষক জীবন শুরু হলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×