কোন এক দুর্সম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে আসিফের সাথে পরিচয় পাতার। এক বছর আগে বন্ধুদের সাথে মিলে ডিভির জন্য অ্যাপ্লাই করেছে। তার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না, বন্ধুরা করছে, তাই সেও চেষ্টা করে দেখা। কিন্তু, ভাগ্যক্রমে, তার নাম লটারীতে উঠেছে। এই কথা শোনার পর থেকেই অনেকে অনেক রকমের আবদার নিয়ে আসছে। দালালদের তার চার পাশে ঘোরা বেড়ে গেছে।
কি মনে করে যেন ডিভি ফর্মে সে নিজেকে বিবাহিত পরিচয় দিয়েছে। এখন বউ সহ তার আমেরিকায় যাবার সুযোগ হয়ে গেছে। কিন্তু সে গার্লফ্রেন্ডই পায়না, বউ পাবে কোথায়। অনেকেই তার কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। শেষে একজন বুদ্ধি দিল, আমেরিকায় গিয়েই যে ভাল চাকরি পাবে, তা তো না। তার চেয়ে, এখানে অনেক মেয়ে আছে যারা অমেরিকায় যাওয়ার জন্য পাগল। অনেকেই আছে যার স্বামী আমেরিকায়, সে যেতে পারছে না। এমন একজনকে টাকা নিয়ে বউ দেখিয়ে আমেরিকায় নিয়ে যেতে পারলে অনেক টাকা। প্রথম গিয়েই চিন্তায় পরতে হবে না।
আসিফ চিন্তা করল প্রস্তাবটা মন্দ না। তাছাড়া এই বয়সে তার বিয়ের করার ইচ্ছাও নেই। তাড়াহুড়ায় ঠিক মত যাচাই না করে বিয়ের মত এত বড় একটা কাজ করা ঠিক হবে না। এদিকে বউ নিয়ে অ্যাম্বেসীতে না গেলে মুশকিল। মিথ্যা বলার জন্য না ওর ভিসাটাও ওরা বাতিল করে দেয়।
এরকম প্রায় ৪-৫ জন যুবতীর সন্ধান পাওয়া গেল যারা দীর্ঘ্যদিন স্বামী ছাড়া দেশে পরে আছে। সবাই গড়ে ৩০-৩৫ লক্ষ টাকা দেবার কথা বলছে। আসিফ সবার সাথেই দেখা করেছে এবং কেন যেন এদের কাউকেই এত বড় সাহায্য করার ওর ইচ্ছা করেনি। মনে হচ্ছে, স্বামীর কাছে যাওয়ার চেয়ে আমেরিকায় যাওয়াটা এদের কাছে মূখ্য।
এরকমই একজন পাতা। দেখা করার দিন পাতার নিস্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষন খারাপ লাগে আসিফের। মেয়েটার বয়স হবে ২৩ বছর। ১৭ বছর বয়সে বিয়ের পরে স্বামীর সংগ পেয়েছে মাত্র ১২ দিন। বিয়ের আগে জানত না স্বামী অবৈধভাবে আছে অমেরিকাতে। অবশ্য রানা, পাতার স্বামীকেও খুব একটা দোষ দেয়া যায়না। ওদের বিয়েটা হয়েছে মাত্র ২ দিনে। রানার চলে যাবার সময় হয়ে এসেছে। হঠাৎ এই প্রস্তাব আসার পর তার মা কান্না কাটি শুরু করেন, ঘরে একটা বউ রেখে যাবার জন্য। পাতাকে দেখে ভীষন ভাল লেগে যায় রানার। তাই সেও আর মানা করেনা। তাকে কেউ অমেরিকার গ্রীন কার্ড আছে কিনা এই ব্যপারে জিজ্ঞেস করেনি, সেও কোন উত্তর দেয়নি। সেটা যে সে ইচ্ছা করে গোপন করেছে তা না। পাতার বয়স অল্প। তাই বাবা-মা-ই ওর হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। ওর মতামত কেউ জানতেও চায়নি। আর ও বাবা-মায়ের মতামত মেনে নেয় চুপ-চাপ। ৭ বছরে শত চেষ্টা করেও আর বউ এর কাছে আসতে পারেনি পারেনি, বউকে নিতে পারেনি তার কাছে। নানা ভাবে চেষ্টা করেছে, কাজ হয়নি।
পাতার স্বামীর সাথেও কথা হয় আসিফের। ভিসা হওয়ার সাথে সাথে ওরা তাকে ৫০ লক্ষ টাকা দেবে বলে জানায়।
এর পর শুরু হয় পাতাকে জানার পর্ব। পাতা জানতে থাকে আসিফকে। অ্যাম্বেসী ওদের বিয়ের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য নানা রকম প্রশ্ন করবে। সেই প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টায়ই দুই জনের এই ঘনিষ্টতা। হাতে আছে প্রায় ২ মাস। এর মধ্যে প্রতিদিন ওরা দেখা করে। আমেরিকায় যাওয়া উপলক্ষে আসিফ চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে। তাই হাতে অফুরন্ত সময়। রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে কত কথা হয়। কখনো রিক্সা করে ঘুরে বেড়ায়, কখনো বা কোন ফাস্ট ফুডের দোকানে কাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা। এভাবে দু’জনে দু’জনের কাছে চলে আসে।
পরিবার থেকেও ওদের দেখা সাক্ষাতে কোন বাধা নেই। প্রায় ২ সপ্তাহ পর থেকে তাদের প্রতি রাতে ফোনে কথা হতে থাকে। দু’জনে ভীষন ভালো বন্ধুর মত সারাক্ষন গল্প-হাসি-ঠাট্টা এই করেই সময় কাটায়। পাতা প্রায়ই আসিফের বাসায় চলে আসে। ওর মাকে রান্নায় সাহায্য করে। তারপর বিকালে ওর পুরো পরিবারের সাথে আড্ডা দিয়ে সন্ধায় আসিফ তাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসে। ভবিষ্যত নিয়ে কত রকমের জল্পনা-কল্পনা হয়। কত স্মৃতি নিয়ে কথা হয় দু’জনে।
২ মাস চোখের পলকে ফুরিয়ে যায়। হাসতে খেলতে ওদের ভিসাও হয়ে যায়। রানা আসিফকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে চাইলে আসিফ বলে আমেরিকায় যাওয়ার পর টাকাটা ওকে দিলে ওর বেশি কাজে লাগবে। এই মূহুর্তে টাকাটা ওর বাবা-মাকে দিয়ে যেতে হবে না।
ভিসা পাওয়ার ১৫ দিন পর দুই জনে পা বাড়ায় আমেরিকার পথে। যাবার পথে লন্ডনে ১ রাতের বিরতি। স্বামী-স্ত্রী হিসাবে যাচ্ছে দু’জন। তাই হোটেলে এক রুমে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়। দু’জনে সারা রাত লন্ডনের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। পরদিন আবার যাত্রা শুরু হয়।
আমেরিকার মাটি স্পর্শ করে তাদের প্লেন। প্লেন থেকে নেমে দু’জনে ইমিগ্রশনের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ দু’জনেরই মনে পরে যায়, এর পর আর এভাবে এত সময় এক সাথে কখনও কাটানো হবে না ওদের। রানাকে দেখার আনন্দের চেয়ে আসফের কাছ থেকে চলে যাবার কষ্টটা পাতার বেশি বিধতে থাকে। ব্যাগগুলো নেয়ার পরই রানাকে দেখতে পায় পাতা। আসিফকে দেখায়। হঠাৎ নিজের অজান্তেই পাতাকে বলে আসিফ, “কি হয় রানার কাছে ফিরে না গেলে? প্লিজ যেওনা”। পাতা ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে আসিফের দিকে। ভীষোন দোটানায় পরে যায়। একবার আসিফের দিকে একবার রানার দিকে তাকাতে থাকে সে। একজন, যাকে চোখ বন্ধ করে ভালোবেসে তার অপেক্ষায় ৭ বছর কাটিয়ে দিয়েছে, আর একজন, যে মাত্র কয়েকদিনে মনের ভীষন কাছে চলে এসছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে পাতা। ওর দেরী দেখে কিছুটা অবাক, কিছুটা বিরক্ত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রানা।