আমার জীবনটা কি অতীতের হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুজে খুজেই শেষ হবে? কেনই বা হারিয়ে ফেলি তাহলে। একবার হারানোর পর যদি আবার আমাকেই খুজে মরতে হয়, তাহলে, শুরুতে হারাতে না দিলেই হয়। কিন্তু, আমি কেন যেন ধরে নেই আমার কাছের মানুষগুলো কাছেই থাকবে সারাজীবন। আমি অযত্নে অবহেলায় হারিয়ে ফেললেও ওরা ঠিক থেকে যাবে আমার আশ-পাশে। এই ধারনা নিয়ে থাকলেও অবহেলা বুঝি এই একজনের ক্ষেত্রেই বেশি দেখিয়েছি।
এই ব্লগ তো আমার আশার সঞ্চার করে দিল। আমার ১৩ বছর পুরোনো কলিগকে খুজে দিল, আর স্যারকে বের করতে পারবে না?
আমি খুব ছোট বেলা থেকে একটা আজব স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নের ভয়েই বুঝি পরিচিত মুখগুলো খুজে মরছি। আমার স্বপ্নটা থাকে অনেকটা এমন যে, আমার অবহেলায় অতিষ্ট হয়ে আমার পছন্দের মানুষগুলো আমাকে ছেড়ে যায়, আবার যাবার সময় সুন্দর বলে যায়, যেদিন আমি মন থেকে ওদেরকে অনুভব করে খুজব, সেদিন ফিরে পাব। কি সুন্দর! ফাইজলামি যত্তসব! আমি জানি, স্বপ্ন আমাদের কল্পনারই প্রতিফলন। কিন্তু, আমি কি এই করে বেড়াব? আমাকে কেউ খুজে বের করলে কি ক্ষতি হত?
খুব বেশি অভিমান দেখিয়ে ফেললাম বোধ হয়। আর একটা মিথ্যা অপবাদও দেয়া হয়ে গেছে। মামুন স্যার আমাকে খুজে ঠিক বের করেছিলেন একবার। আমিই বুঝি উনার সম্মান রাখতে পারিনি।
২০০০ সালে আমার শিক্ষক ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে আমার পরীক্ষা অবদি প্রায় ৮ মাস আমাকে পরিসংখ্যান তিনিই করিয়েছেন। এই বিষয়ে আমার কৃতিত্ত্বের তিনিই আসল দাবীদার। আমি তো ফাকিবাজ ছিলাম। তিনি জানতেন আমার মত ফাকিবাজের কাছ থেকে কি করে পড়া আদায় করে নিতে হয়।
উনার সাথে আমার পরিচয়টাও অদ্ভূত ভাবে। আমি আমার সব বান্ধুবীদের সাথে ঢাকা কলেজের রঞ্জন স্যারের কাছে প্রসংখ্যান পড়তাম। সিলেবাস শেষ হয়ে গেলে, আমার বান্ধুবীরা ঘরে একজন শিক্ষক রাখল ওদের পড়াগুলো প্রতিনিয়ত ঝালাই করার জন্য। সেখানে ওরা আমাকে রাখতে রাজী হলনা .. মেয়েদের যেমন… যাহোক, ভালোই হয়েছে, না হলে আমি এত লক্ষী একটা স্যার পেতাম কোথায়?
আমি মনে মনে সব সময়ই বানর ছিলাম। একটু দুষ্টু, অসম্ভব জেদী, আহলাদী, কিন্তু অনেক লক্ষী।
আমি লক্ষী মেয়ে, কোন দিন হোম ওয়ার্ক করিনি। প্রথম দিনই তিনি মায়ের কাছে বিচার দিয়েছিলেন আমার নামে। আম্মু স্যারের সামনেই আমাকে বকা দিল। আমার ভীষন রাগ হয়ে গেল। মা ঘর ছেড়ে যেতেই ধৃষ্টতা দেখালাম। উনাকে বললাম, পড়বনা আমি। পারলে আম্মুকে বলেন আপনাকে হোমওয়ার্ক করে দেখাতে। উনি বললেন, আচ্ছা, না পড়লে আমি আজকে চলে যাই, কালকে আসব আবার। আমার তখন রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। ফাইজলামি নাকি! উনি এখন চলে গেলে আম্মু আমাকে খুন করবে। আমি বললাম, আমি পড়ব না আর আপনারও এখন যাওয়া হবে না। ২ ঘন্টা চুপচাপ বসে থেকে তারপর যাওয়ার নাম নেবেন। বলে আমি বসে বসে নখ খাওয়া শুরু করলাম। আমার টাইম পাসের এটা খুব ভাল একটা পদ্ধতি। আমি ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে মন দিয়ে নখ খেতে পারতাম। এখনও বোধ হয় পারব। তবে এখন ইন্টারনেট বুঝে গেছি, তাইতো অবহেলায় নখগুলো একটু প্রান পেয়েছে।
সে যাই হোক, কিছুক্ষন যাবার পর উনি আমাকে বললেন, কালকে তোমার অঙ্ক করা দেখে আমার ভীষন ভালো লেগেছে। আমি ভাবছিলাম আজকে একটা অঙ্ক দেব, যেটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। শুধু আমার না, ক্লাশের বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীই এটা অনেক বারের চেষ্টায় আয়ত্বে এনেছে। মনে হয় কেউই এটা এক চান্সে করতে পারেনি। আমি ভাবছিলাম, আজকে সেই অঙ্কটা তোমাকে করতে দেব।
সাথে সাথে কি মনে হল। কি যেন চিন্তা করে বললাম, কোন অঙ্কটা? তিনি দেখালেন। কোনটা ঠিক মনে পড়ছে না। যতদূর মনে হয়, Standard Deviation না কি যেন একটা নাম ছিল। আমি বললাম, আচ্ছা, শুধু এই একটা করব। আর করব না। তিনি, বদ, বললেন, থাক, আজকে তোমার ইচ্ছা নেই। পরেই কর। আমার তখন আরও মেজাজ গরম। আমি বললাম করব! যাহোক, তিনি একবার বুঝিয়ে দিতেই আমি বুঝে গেলাম। আমার কাছে তেমন কঠিনও মনে হল না। আমার ধরনটাই এমন বোধ হয়। সহজ জিনিসগুলো আমি বুঝি না। কিন্তু যত কঠিন হয়, আমার তত ভালো লাগে।
যাহোক, তিনি বললেন বুঝেছ যে, আর একটা করে না দিলে আমি বুঝব কি করে? আমি বললাম, আচ্ছা, কোনটা করব? তিনি দেখালেন, আমি করে দিলাম। এভাবে ৩/৪টা অঙ্ক করিয়ে নিলেন। তারপর তার যাবার সময় এলে বললেন, কালকে হোমওয়ার্ক করে রেখ? আমি বললাম, হোমওয়ার্ক আমি কোনদিনই করব না। ঐটা আম্মু করবে। আম্মুকে বলে যান করে রাখতে। তিনি কিছু না বলে হেসে বিদায় নিলেন। উনার অত্যাচারে আমি প্রথম দিনই বিরক্ত। আজকে বুঝি, তিনি আমাকে কত্ত ভাল বুঝেছিলেন। কি সুন্দর আমাকে দিয়ে অঙ্ক করিয়ে নিয়েছিলেন, আমি বুঝিইনি । অসহ্য।
এরপর একটা সময় ছিল যখন আমাদের মধ্যে জটিল একটা খেলা চলত। তিনি বইয়ের যেকোন অঙ্ক দেবেন। আমি উনাকে উত্তর বলে দেব। আমি পেরেও যেতাম বেশির ভাগ সময়ে।
আমার জীবনের একটা ভয়ংকর দিনে স্যার আমাকে পড়াতে এসে অনেক কথা বলেছিলেন। আমার খুব আদরের এক চাচা মারা যাবার দিন। সে বিষয়ে আর মনে করতে চাইনা। এতটুকু বলি, তখন আমি মানুষের সামনে কাদতে পারতাম না। তিনি আমাকে কাদতে দেখেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, তিনি যখন ক্লাশ থ্রি-তে পড়েন, একবার কিছু একটা নিয়ে কাদছিলেন। হঠাৎ তার চোখ পড়ল আয়নার দিকে। তিনি দেখলেন, তাকে দেখতে ভূতের থেকেও খারাপ লাগছে। সেই থেকে তিনি কান্না করা ছেড়ে দিয়েছেন। আজকে কথাটা মনে পরে হাসি পেলেও সেদিন উনাকে খুন করতে ইচ্ছা করছিল।
স্যারের কথায় আসি। দেখতে দেখতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময় চলে এল। যথারীতি প্রথম পরীক্ষা ইংরেজী। তিনি তার আগের দিনও এসে হাজির। আমি বললাম, আমি আজকে তো স্ট্যাট করব না। তিনি বললেন, আমি তোমার ইংলিশের প্রিপারেশন দেখতে এসেছি। এভাবে তিনি প্রতি পরীক্ষায় এসে হাজির হয়েছিলেন।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ। তখন আমার শরীর ভীষন রকম খারাপ। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখনো তিনি নিয়মিত আসতেন। তখন প্রাক্তন শিক্ষক হিসাবে আসতেন। বেতন নিতেন না। আসতেন আমার অবস্থা জানতে। আমাকে নানা ভাবে অনুপ্রানিত করার চেষ্টা করতেন। আমার অসুস্থতার জন্য কোন কিছুই ভাল লাগত না আমার। তারপর একসময় স্যারের আসা বন্ধ হয়ে গেল। আমি খেয়ালও করিনি।
ঢাকা ভার্সিটিতে হলনা আমার। আমি প্রাইভেট একটাতে ভর্তি হয়ে গেলাম। ভার্সিটির কাছাকাছি থাকার জন্য বাসা বদল করলাম। প্রায় দেড় বছর পর একদিন হঠাৎ বাসায় ফিরতেই আম্মু বলল, তোমার মামুন স্যার এসেছিলেন। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তিনি এই বাসার ঠিকানা কোথায় পেলেন? মা বললেন, কোন এক আমলে আমার চাচাতো বোনকে পড়াবেন বলে আমার চাচার বাসার নম্বর উনাকে দেয়া হয়। বোনকে আর পড়ানো হয়নি উনার। কিন্তু নম্বর রেখে দিয়েছিলেন। চাচারাও বাসা বদলেছিল। কিন্তু একই এলাকা বলে তাদের নম্বর বদলায়নি। সেখানে ফোন করে তিনি নতুন বাসার ঠিকানা নিয়েছে। সারপ্রাইজ দেবে বলে ফোন করে আসেনি। আমার সাথে দেখা হয়নি। বলে গিয়েছিলেন তিনি রাজশাহীতে কোন এক কলেজে শিক্ষকতা করছেন। উনার এক রুমমেটের নম্বরও দিয়ে গিয়েছিলেন। কখনও ফোন করা হয়নি। প্রায় ৫ বছর পর লন্ডন থেকে ফিরে একবার আম্মুর বিক্ষিপ্ত টেলিফোন ডিরেক্টরী ঘেটে উনার সেই রুমমেটের নম্বর বের করে যখন ফোন করলাম, জানলাম, উনার বন্ধু নম্বরটা অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে। তার নতুন নম্বর সেই ভদ্রলোক দিতে পারলেন না।
উনার ব্যপারে বেশি কিছু জানিনা খুজে বের করার মত। উনার বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে। মনে আছে তখন উত্তরাতে উনার বড় বোন থাকতেন। তার বাসা থেকেই তিনি আমাকে পড়াতে আসতেন। যতদূর মনে পরে উনার বাবা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। ছোট একটা ভাইও বোধ করি ছিল উনার। মনে নেই। ডাক নাম মাসুম মনে হয়। তবে ভাল নাম মামুন তাতে সন্দেহ নেই। কোন সহৃদয় ব্যক্তি যদি তাকেও খুজে দিত!!!