ধর্মের ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্র কি টিকে থাকতে পারে?
-------------------------------------------------------
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল দর্শন খুব পরিষ্কার রাষ্ট্র সকল নাগরিকের, কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা বিশ্বাসের একচ্ছত্র সম্পত্তি নয়। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক বোধের বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্র হলো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো, যেখানে একসঙ্গে বহু ধর্ম, মতাদর্শ ও জীবনদর্শনের মানুষ সহাবস্থান করে। প্রশ্ন হলো, ধর্মকে ভিত্তি করে কি আজকের দিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা সম্ভব?
প্রথমত, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র স্বভাবতই বর্জনমূলক। কারণ, যে ধর্মকে রাষ্ট্রের মূল পরিচয় করা হয়, সেই ধর্ম অনুসারীরা স্বাভাবিকভাবেই বিশেষ মর্যাদা পায়, আর অন্য ধর্মের মানুষ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। এতে রাষ্ট্রীয় সমতা, নাগরিক অধিকার ও আইনের সামনে সমতার ভিত্তি দুর্বল হয়। আধুনিক গণতন্ত্রের প্রধান নীতি সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে কার্যকর রাখা কঠিন।
দ্বিতীয়ত, আজকের বিশ্বে সমাজগুলো বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও মতাদর্শের সমন্বয়ে গঠিত। একটি ধর্মের ব্যাখ্যা বা নিয়ম অন্য ধর্মাবলম্বীর কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তাছাড়া, ধর্মীয় আইন সাধারণত পবিত্র ও অপরিবর্তনীয় হিসেবে দেখা হয়; অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় আইন সময়, সমাজ ও প্রয়োজন অনুসারে সংশোধনের দাবি রাখে। এই দুইয়ের সংঘাত রাষ্ট্রকে জটিল সংকটে ফেলতে পারে।
তৃতীয়ত, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে “রাষ্ট্র কোন ধর্মের ব্যাখ্যা অনুসরণ করবে”এটাই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক বিতর্ক ও সংঘাতের উৎস। একই ধর্মেরও নানান ব্যাখ্যা, মতবাদ ও উপদল আছে। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মতবিরোধ বাড়ে, আইন প্রণয়ন হয় বিভক্তির ভিত্তিতে, এবং সমাজে সামগ্রিকভাবে অবিশ্বাসের চাষাবাদ ঘটে।
চতুর্থত, বিশ্বায়ন, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন আজ রাষ্ট্রকে নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বিশেষত ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে প্রায়ই দেখা যায়, ধর্মান্তর, মত প্রকাশ, বা ধর্মীয় আচার পালনে অনেক নিষেধাজ্ঞা আসে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ কথা সত্য, ধর্ম মানুষের জীবনে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতার উৎস হতে পারে; রাষ্ট্র সে মূল্যবোধ থেকে পথনির্দেশ পেতেই পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তি হওয়া উচিত সামগ্রিক মানবাধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও সমতার নীতি যা সকল ধর্মাবলম্বীর অধিকারকে সমানভাবে মর্যাদা দেয়।
অতএব, আধুনিক সভ্যতা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে: ধর্মকে সম্মান করা যায়, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্মের ভিত্তিতে দাঁড় করানো যায় না। কারণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব নাগরিকের জন্য সমান নিরাপত্তা, সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা নিশ্চিত করা যা কেবল ধর্মনিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব।
যেখানে রাষ্ট্র সবার ধর্ম সবার ব্যক্তিগত; আর এই দূরত্বই আধুনিকতার শক্তি।

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


