খাদ্য ছাড়া আমরা বাচি না। কিন্তূ এ খাদ্য এখন মরণের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। দেশে নিরাপদ খাদ্য বলতে কিছু নেই। সবই ভেজালে সয়লাব। আর ভেজাল মানেই তো বিষ।
চারদিকে ভেজালের জয়জয়কার : শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র ভেজালের দৌরান্ত । এক নির্ভরযোগ্য তথ্য থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ খাদ্য সামগ্রী বিষাক্ত। তাহলে আমরা কি নিত্য বিষ খাচ্ছি? ভেজাল বিরোধী অভিযানে জানা গেছে চাল,ডাল, মাছ, গোশত, ভোজ্যতেল, ঘি, চিনি, লবন, দুধ, দই, মিষ্টি, আইসক্রিম, চকোলেট, ফ্রুট জুস, কোল্ড ড্রিংস, জেলি, শিশু খাদ্য, গুড়ো দুধ, মসলা, ফল ফলাদি সহ শতাধিক খাদ্য সামগ্রীতে ভেজাল বিদ্যমান।
বেশীদিন আগের কথা নয়- এ সোনার দেশটির মানুষ খেতো নির্ভেজাল সোনার খাবার। ঠেকি ছাটা চালের ভাত, যাতায় ভাঙা ডাল, পালের গাভির দুধ, হাতে ভাড়া মুড়ি, হাতে বানানো ঘি, ঘরে পাতা দই, ঘানিতে ভাঙানো সর্ষে তেল, মিঠা পানির সুস্বাদু দেশী মাছ, চাক ভাঙা মধু, ক্ষেতের টাটকা সবজী, গাছ পাকা ফল আরও কত মজাদার নির্ভেজাল খাবার। মেহমান আপ্যায়ন করা হতো ডাবের পানি বা লেবুর শরবত দিয়ে। এখন আর সেদিন নেই। বর্তমানে চটকদার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে খাটি গাওয়া ঘি, খাটি সরর্ষে তেল, খাটি দুধ, খাটি মধু। আগে খাটি লেখার প্রয়োজন হতো না। কারণ মানুষগুলো ছিল খাটি, জিনিষগুলোও ছিল খাটি। এরই মধ্যে বিজ্ঞান প্রযুক্তি অনেকদুর এগিয়ে গেছে। সে সুবাদে এক শ্রেণীর অসাধু ও লোভী ব্যবসায়ী দৌরান্তে আল্লাহ প্রদত্ত খাটি জিনিষগুলো ভেজালে সয়লাব হয়ে গেছে। খাটির নামে চলছে সবই খাটি। এভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে ১৬ কোটি মানুষ।
ভাত বাঙালির প্রাণ। আমরা ভোতো বাঙালি। ডাল-ভাতে বাঙালি। মাছ- ভাতে বাঙালি। সাদা চালে রং মাখিয়ে লাল বিরুই বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লাল রং মিশিয়ে বানানো হয় লাল আটা, ডালে রং মিশিয়ে চকচকে করে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করা হয়। মাছ, গোশত তরতাজা রাখার জন্য মিশানো হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন যা লাশের পচন রোধে ব্যবহার করা হয়। আরও বিপদজনক হল এখন বরফের সঙ্গেই ফরমালিন মিশিয়ে মাছ তাজা রাখা হচ্ছে। এ জীবন হন্তাকর ফরমালিন এখন ব্যাপক হারে ব্যাবহার করা হচ্ছে মাছ ফল ও দুধ তাজা রাখার জন্য। ফল বিষে ভরা। তাই অনেকেই ফল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এখন ফল পচতে দেখা যায় না।খাবারের সংগে ফরমালিন মানবদেহে প্রবেশ করলে ধীরে ধীরে কিডনী, লিভার, হৃদপিন্ড, ফুসফুস নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে পেট ব্যথা, হাইপারটেনশন, শ্বাসকষ্ট। ফরমালিন বেশী মাত্রায় শরীরে ঢুকলে রক্তে প্রোটিন জমাট বেঁধে যায় যা শরীরের কোন কাজে লাগে না। ফল বিশেষ করে অপুষ্ট ফল পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ক্যালসিয়াম কার্বাইড। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত এসব ক্যামিক্যাল ব্যবহারে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এমনকি ক্যান্সার বেড়ে যাচ্ছে।
পানির অপর নাম জীবন। আমাদের মতো গরিব দেশে পানি বিক্রি হবে তা কিছুদিন আগেও কল্পনাও করা যায়নি । পরীক্ষায় দামি বোতলজাত পানিতেও জীবানু, ক্ষতিকর লিড, ব্যাডমিয়াম ও জিংক পাওয়া গেছে। তাই এসব দামি দামি পানি খাওয়াও এখন স্বাস্থ্যের জন ঝুকিপূর্ণ। ইউরিয়া সার ফসলের খাদ্য। কিন্তূ আজকাল মুড়ি ভাজা হয় ইউরিয়া দিয়ে। ইদানিং আবার হাইডোজের মতো বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করে মুড়ি ফোলানো ও ধবধবে সাদা করা হচ্ছে। সর্ষে তেলের মধ্যে সাবান তৈরীর কাষ্টার তেল ও ঝালালো বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে খাঁটি সর্ষে তেল বলে দেদারছে বিক্রি করা হচ্ছে।
পাটালি গুড়ের পায়েস জামাই ভোলানো খাবার । চিটাগুড়, চুনের সংগে সালফেট, হাইডোজ মিশিয়ে তৈরী করা হচ্ছে আকর্ষনীয় পাটালী গুড়। এসব কেমিকেলের দরুন লিভার কিডনী ও অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি দেখা দিচ্ছে।
বিস্কুট, কেক, লোভনীয় আইসক্রিম, চকোলেট, তিলের খাজা, সেমাই, আচার, নুডুলস, জ্যাম জেলী, দই, মিষ্টি ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয় টেক্সটাইল (কাপড়), লেদার (চামড়া) ও কাঠ শিল্পের রং যা মানুষের শরীরের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। চমমচে রাখার জন্য গাড়ির পোড়া মবিল দিয়ে ভাজা হয় প্যাটিস, চানাচুর, নুডুলস, বিস্কুট, সমুচা ইত্যাদি। পামওয়েল, হুইল পাওডার, সাবান, গরু খাসির চর্বি, মিষ্টি কুমড়া বা গাজর পিষে বিষাক্ত ক্যামিক্যাল ফ্লেভার মিশিয়ে তৈরী করা হয় ঘি। মসলায় মিশানো হচ্ছে কাঠের গুড়ো ও ইটের গুড়ো। শুটকিতে মিশানো হয় মারাত্বক কীটনাশক। মানুষ খাবে কি? শাকসবজীতেও মিশানো হয় বালাইনাশক বিষ। দুধ আদর্শ খাদ্য। এখন অভিনব কায়দায় তৈরী করা হচ্ছে কৃত্রিম দুধ যা শুনলে পিলে চমকে উঠার মতো। দুধের ছানার সংগে বিষাক্ত পারক্সাইড, খাওয়ার সোডা, চর্বি, রং ও ক্যামিকেল মিশিয়ে তৈরী করা হচ্ছে কৃত্রিম তরল দুধ। এ দুধ শিশুসহ অন্যরা খেলে মারাত্বক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
আজকাল কোল্ড ড্রিংস কিশোরদের কাছে ফ্যাশন। আর যুবকদের কাছে নেশা। সাময়িক আরাম ও আনন্দ পেতে বিশেষ করে প্রচন্ড গরমে ফ্রিজের ঠান্ডা সেভেন আপ, কোক, পেপসি, টাইগার অনেকের কাছে লোভনীয় পানীয়। কিন্তু তারা জানে না এসব কোমল পানীয় শরীরের জন্য কত ক্ষতিকর। এসবের মধ্যে থাকে চিনি, স্যাকারিন, ক্যাফেইন, এসপারটেম, ফ্লেভার, রং, ক্যামিকেল ও কৃত্রিম প্রিজারভেটিভ। বিশেষজ্ঞদের মতে ক্যাফেইন হার্ট ও স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ভীষন ক্ষতিকর। ১ গ্লাস ঠান্ডা পানীয়ের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ৩২ গ্লাস পানি খেতে হয়। বাজারে ফ্রুট জুস, ম্যাংগো জুস, ফ্রুটো ইত্যাদিতে নামে মাত্র ফলের রস থাকে। অতিরিক্ত কোল্ড ড্রিংস ও ফ্রুট জুস পানে অভ্যস্ত যুবকরাও ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হওয়ায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছেন না।
জীবন রক্ষাকারী ওষুধে ধরা পড়ছে ভেজাল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদকে জানান ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের জন্য ১৬ টি কোম্পানীর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এ থেকে সহজেই আঁচ করা যায় যে ওষুধও বিষমুক্ত নয়।
ভেজালের ভয়ংকর রূপ : ভেজাল জাতির জন্য অভিশাপ। ভেজাল তথা বিষাক্ত খাদ্য গোটা জাতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল ও নিম্ন মানের খাবার খেয়ে দেশের মানুষ বিভিন্ন মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজাল দুধ দিয়ে শিশু খাদ্য তৈরী হওয়ায় শিশুরা বিষক্রিয়ায় বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গর্ভবতী মহিলারা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিচ্ছে। প্রতিবন্ধী, হাবাগোবা ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে দ্বিগুন হারে। গোটা জাতি মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয়ের সন্মুখীন।
পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের পরীক্ষকদের মতে, নকল ট্যাংক ও চকলেট খেয়ে শিশু ও বয়স্ক যে কোন মানুষের কিডনী, লিভার দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
• মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার খেতে খেতে কিডনী লিভার, ফুসফুস, চোখের দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বেড়ে যাচ্ছে বদহজম, পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, গ্যাষ্টিক, আলসার, হৃদরোগ, জন্ডিস, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, স্নায়ুরোগ এমনকি ক্যান্সার।
• দেশে প্রতি বছর নতুন করে ২ লাখের বেশী লোক ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হচ্ছে।
• কিডনী রোগীর সংখ্যা এখন প্রায় ১ লাখ বিশ হাজার। ক্যান্সার রোগের সংখ্যা আরও বেশী ভেজালের কারনে এসব মৃত্যুঘাতী রোগ হু হু করে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
ভেজাল চিনুন সুস্হ থাকুন : দেশের প্রতিটি খাদ্যই ভেজালে ভর্তি। ভেজালে অন্তরালে থাকে বিষ। প্রতিনিয়ত আমরা বিষ উদরস্থ করছি। আর আক্রান্ত হচ্ছি নানা রোগ ব্যাধিতে। ভেজাল নিরব ঘাতক। ভেজালের বিষক্রিয়া তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তাই এ নীরব মৃত্যু নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যাথা নেই। দিনাজপুর ও ঠাকুরগায়ে বিষাক্ত লিচু খেয়ে ১৪ টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আরও করুণ হলো যে ব্যক্তি বিষ স্প্রে করেছিল তার ছেলেরও মৃত্যু হয়েছে।
এ জন্য ভেজাল চেনা জরুরীর চেয়েও জরুরী হয়ে পড়েছে। এ প্রসংগে ভেজাল খাদ্য চেনার কিছু টিপস দেওয়া হলো।
১. ফরমালিন দেয়া মাছ চেনার উপায় : রুই মাছে ফরমালিনের ভয় বেশি। পানিতে ফরমালিন মিশিয়ে মাছ ডুবানো হয় বা বরফে ফরমালিন মিশিয়ে মাছ রাখা হয়। কখনও বা ইনজেকশনের শিরিঞ্জ দিয়ে নাড়ি ভুড়িতে ফরমালিন ডুবানো হয়। রান্না করার পরও বিষাক্ততা কমে না।
• ফরমালিন দেওয়া মাছের চোখ ভিতরে ঢুকে যায়।
• মাছ ফ্যাকাশে দেখায়, শরীরে পিচ্ছিল পদার্থ থাকে না।
• ফুলকা কালচে বর্ণের হয়।
• মাছের শরীর শুকনো থাকে।
• মৃত্যু ভয়ে ফরমালিনযুক্ত মাছের উপর মাছি বসে না।
২. রং দেয়া মাছ চেনার উপায় : পচা বা আধাপচা মাছে কাপড় ও কাগজ শিল্পে ব্যবহৃত ক্রাইসোডান, অরামিন জাতীয় রঙ মিশানো হচ্ছে,
• ভাল করে খেয়াল করলে মাছের মুখ, কানকা, চোখ, বুকের পাখনা ও পেটের দিকে চকচকে রঙিন দেখতে পাবেন, এসব ক্ষতিকর রং রান্না করলেও নষ্ট হয় না যা কিডনী, লিভার এর জন্য ক্ষতিকর। তাই সাবধানে মাছ চিনে কিনুন।
৩. ভেজাল গোশত চেনার উপায় : ফরমালিন মেশানো গোশত শক্ত হয় ও শুকনা দেখায়। মাছিও বসে না।
৪. ভেজাল ফল চেনার উপায় : ফলের রাজা আম, লিচু, কলা, পেপে ইত্যাদিতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যাবহার করলে পাকার পর নিজস্ব স্বাভাবিক বা প্রাকৃতির রং হারিয়ে ফেলে। আশ্বিনা আমের স্বাভাবিক রং নীল-সবুজ। কিন্তু বাজারে দেখা যায় আশ্বিনা আমও হলদে বা কালচে হয়ে গেছে। ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়ে এ আম কিনছে সর্বাগ্রে। ফলের চামড়া অস্বাভাবিক টকটকে লাল/হলদে/গোলাপি নান্দনিক রং ও আনারসের চামড়া পোড়া পোড়া বা লালচে দেখলে বুঝবেন ভেজাল আছে।
• ঝুড়িতে সবগুলো ফল সমরুপ অথবা একই রকম হলে ভেজালের লক্ষণ। স্বাভাবিক অবস্থায় একটা ফল থেকে অন্যটা এমনকি একই ফলের দেহের রং এর মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য থাকে।
• অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে ফলের শাঁস শক্ত হয়। খেতে কখনও পানসে আবার কখনও তেতো বা বিস্বাদ লাগে। ফল চাষ করা উত্তম ও নিরাপদ। কলমের চারা গাছে দু’এক বছর পরই প্রচুর ফল ধরতে থাকে। টবেও চাষ করা যায়। সম্ভব হলে ফলের চাষ করে খাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ
৫. ভেজাল চাল, আটা, ডাল চেনার উপায় : রঙিন চালে একটু পানি বা থুতু দিয়ে আঙ্গুলে ঘষা দিন, সাদা রঙের হয়ে গেলে বুজবেন রং দেওয়া হয়েছে। লালচে আটা না কিনে সাদা আটা কিনুন। লাল আটা আপনার কাছে প্রিয় হলে লাল গম কিনে ভাঙ্গিয়ে নিন। অস্বাভাবিক কালচে মসুর ডাল না কেনায় ভাল। অতি উজ্জল চকচকে মুগ ও ছেসারি ডাল কিনবেন না। স্বাভাবিক রং পরখ করে কিনুন।
ভেজাল মধু চেনার উপায় : গ্লাসে পানি ভরে কয়েক ফোটা মধু ঢেলে একটু অপেক্ষা করুন। পানির সংগে মিশে গেলে বোঝা যাবে এটা ভেজাল মধু। আর গদি মধুর ফোঁটা গ্লাসের তলায় চলে যায় তাহলে বুঝবেন এ মধু খাটি ।
• ধাতব পাত্রে ছোট ছিদ্র দিয়ে মধু ঢালুন। যদি আকাবাকা হয়ে পড়ে তাহলে মধু খাটি।
• কয়েক ফোটা মধু সাদা কাপড়ে রেখে তা ঘসে ধুয়ে ফেলুন। যদি কোন দাগ না থাকে তাহলে সে মধু খাটি।