বাংলাদেশে ভোট কলঙ্কিত হয় বরাবরই। মাঝখানে চারটি নির্বাচন তুলনামূলকভাবে কলঙ্কমুক্ত ছিল। নব্বই দশকের পর ’৯৬ সালে ভোট হয়েছিল একতরফা এবং গায়েবী। যে নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী বয়কট করেছিল। এ অবস্থায় ভোট পড়েছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ভোটের ইতিহাসে উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে কম। কাল যে ভোট হতে যাচ্ছে সেখানে কত ভাগ ভোট পড়বে। বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব খবরাখবর আসছে তাতে মনে হয় ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বেশিও হতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাসক দলের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, “ভোটার আনার জন্য প্রয়োজনে টাকা খরচ করতে বলা হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের বলা হয়েছে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে ব্যালটের প্রতি সুবিচার করতে।”
শাসক দলের এমপি শেখ আফিলউদ্দিন তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন ভোটারের দরকার নেই। ১০০ কর্মী পর্যায়ক্রমে ভোটকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাকি কাজটা নির্বাচনী এজেন্টরা সেরে ফেলবে। এরকমই কিছু ঘটতে যাচ্ছে ৫ই জানুয়ারির ভোটে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেই এই নির্বাচনে। জামায়াতে ইসলামীও নেই। এরশাদের জাতীয় পার্টি আছে এবং নেই। প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে সরে গেছেন এরশাদ। পরিণতিতে হাসপাতাল নামক আধুনিক জেলখানায়।
খাঁচায় বন্দি থেকেও গলফ খেলে দুনিয়াকে দেখাচ্ছেন ভোট বয়কট করাটা যে কত বড় বিপজ্জনক। খালেদা বন্দি ৭৯ গুলশানে। ইকোনমিস্টের ভাষায়, এটাই হচ্ছে বাংলাদেশী গণতন্ত্রের নমুনা। খালেদা সহসা মুক্তি পাবেন এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। যদিও আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর। আন্তর্জাতিক চাপে সরকার টলবে না। নির্বাচন বাতিলে আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। সরকার কি তা শুনেছে। ভবিষ্যতেও শুনবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবরোধ দিলেও কাজ হবে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যদি বিষয়টি উত্থাপন করে তখনও ভাববে এমনটা এখন কেউ আর বিশ্বাস করতে পারছেন না।
দুনিয়া কি বললো, দেশের মানুষ কি বললো, তাতে কি যায় আসে। ক্ষমতায় আছি, ক্ষমতায় থাকবো, এটাই শেষ কথা। ৫ই জানুয়ারি থেকে ২৪শে জানুয়ারি, এই ১৯ দিন বাংলাদেশী রাজনীতির জন্য নতুন কোনো ইতিহাস লেখা হতে পারে। সন্ত্রাস দমনের নামে ভয়ঙ্কর দমন-পীড়ন হতে পারে। এমন একটা ছকের কথা পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন। বলেছেন, “দুই সপ্তাহের মধ্যে সন্ত্রাস নির্মূল করা হবে। সেনাবাহিনীকে আরো দীর্ঘসময় মাঠে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।” আগে কথা ছিল ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানারকম কথাবার্তা চালু রয়েছে শাসক মহলে। যত কথাই বলা হোক না কেন, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনী ফল দিয়ে শেখ হাসিনা দেশ শাসন করতে চাইবেন। আরেকটি নির্বাচন খুব দ্রুত হবে এমন আশা যারা করছেন তারা হতাশ হবেন অল্পদিন পরেই। বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা হবে। জামায়াত নির্মূল হবে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। প্রশাসন আরো দলীয়করণে আবদ্ধ হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভিন্ন দায়িত্ব পাবে। বাকশাল কায়েম হবে অন্য এক মোড়কে।
সর্বোপরি মানবাধিকারের সংজ্ঞা পরিবর্তন হবে। গণতন্ত্র বন্দি হয়ে যাবে চার দেয়ালে। অবিশ্বাস্য বা নাটকীয় কিছু ঘটলে হয়তো অন্ধকার থেকে আলো আসবে। তা না হলে বাংলাদেশীরা একপর্যায়ে আত্মসমর্পণ করবেন অন্য শক্তির কাছে। কোনদিন টের পেলেও শুধু আফসোস করা ছাড়া কিছুই থাকবে না।
অনেকেই বলছেন, খালেদার নির্বাচনে যাওয়া উচিত ছিল। নির্বাচনে কিভাবে যেতেন খালেদা। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি হলেও নির্বাচন হতো কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল এবং আছে। কারণ, শাসক দল গোড়া থেকেই বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে চায়নি। তারা জানে যেনতেন নির্বাচনে হেরে যাবে। তাই খালেদাকে নির্বাচনমুখী করতে দেয়নি তারা। তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের চিন্তা গত নির্বাচনের পরপরই নেয়া হয়। বিশেষ কমিটির আলোচনা ছিল লোক দেখানো। আদালতের রায় শেখ হাসিনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। বিচারপতি খায়রুল হক জানতেন ভবিষ্যত কর্মপন্থার কথা। সে কারণে রায় লেখার সময় তিনি বড্ড বেশি কৌশলী ছিলেন। খালেদা ভুল করেছেন না শুদ্ধ করেছেন তা এখনই হয়তো মূল্যায়ন করা যাবে না। তবে তার সংলাপে যাওয়া উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশবাসীকে বলতে পারতেন আলোচনা অর্থহীন।
সরকার বিরোধী দলকে চায় না সেটা আরো স্পষ্ট করে বলতে পারতেন। তা না করে আবেগ আর জেদ দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চেয়েছেন। জামায়াত নির্ভর হওয়া যে মস্ত বড় ভুল হয়েছে সেটা বোধ করি তিনি এখন বুঝতে পারছেন। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে সন্ত্রাসী দল হিসেবে জামায়াত দুনিয়াব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। কিছুটা হলেও আঁচ লেগেছে বিএনপির গায়ে। সরকার এখানে ভূমিকা রেখেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন হলো, বিএনপি নেত্রী কেন বুঝতে পারলেন না এতে করে তার দলের মডারেট অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে ৭০ ভাগ মানুষের সমর্থনপুষ্ট একটি দলের চেহারা এরকম হবে কেন? রাস্তায় জনগণকে শামিল করা গেল না কেন? তার সঙ্গে যেমন আন্তর্জাতিক শক্তি আছে, তেমনি সরকারের সঙ্গেও রয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তি। খালেদার পক্ষের শক্তিরা হতাশা আর উদ্বেগ প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। আর সরকারের পক্ষের শক্তিরা সরব ছিল অ্যাকশনে। লবিও করেছে আন্তর্জাতিক মহলে। এখনো তারা সোচ্চার। বৃহৎ শক্তিগুলোর দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। খেলাটা কি তা খুব দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে সেটা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী তা বলা যায় অনায়াসে। সূত্র: মানবজমিন।