somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ২

২৯ শে মে, ২০২২ সকাল ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ১

১৯২৯ সালে হাবিবুল্লাহ কালাকানিকে হত্যা করে কিং আমানুল্লাহ এর চাচাত ভাই মোহাম্মাদ নাদির শাহ ক্ষমতা দখল করে কিংডম অফ আফগানিস্তান আবার শুরু করেন এবং নিজেকে কিং ঘোষনা করেন। কিং নাদির শাহ ও তার পূর্বসুরী কিং আমানুল্লাহ এর সংস্কারের পথে হাটেন তবে একটু ধীরে। তিনি বুঝতে পারছিলেন জনগন এত তারাতারি এত পরিবর্তন হজম করতে পারছে না। কিন্তু নাদির শাহ এর শেষ রক্ষা হল না। ১৯৩৩ সালে হাজারা সম্প্রদায়ের ১৫ বছর বয়সের এক বালক আব্দুল খালিকের দ্বারা নাদির শাহ হত্যার শিকার হন। ওই বালক ছিল কিং আমানুল্লাহ এর সমর্থক।

এর পর ১৯৩৩ সালে নাদির শাহ এর ১৯ বছর বয়সি ছেলে মোহাম্মাদ জহির শাহ সিঙ্ঘাসনে আরোহন করেন। ১৯৩৩ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর জহির শাহ আফগানিস্তান শাসন করেন। এ সময় কিং আমানুল্লাহর আফগানী ঐতিহ্যের বিপক্ষের নেয়া সংস্কার কার্যক্রম তিনি বাতিল করেন। এই সময়টা আফগানিস্তান বেশ ভাল একটা সময় পার করে এবং দেশে অবকাঠামো ও শিল্পের ব্যপক প্রশার লাভ করে। ২য় বিশ্ব যুদ্ধ ও স্নায়ু যুদ্ধের সময় আফগানিস্তান নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহন করে এবং দুই পক্ষ থেকেই প্রচুর সাহায্য পায়। স্নায়ু যুদ্ধের সময় রাশিয়া যে সব দেশকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয় আফগানিস্তান তার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে।
এ সময়টাতে আফগানিস্তান মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও সরকারের নিয়ন্ত্রন ছিল মূলত শহরাঞ্চলে। পাহাড়ী ও দূরের উপজাতীয় এলাকাগুলি জিরগা পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত স্থানিয় উপজাতীয় সর্দারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই মূলত এ পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসত। শত শত বছর ধরে আফগানিস্থানে এ প্রথাই চলে আসছে।

১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জহির শাহ এর চাচা শাহ মাহমুদ খান। ১৯৫৩ সালে তার স্থলাভিষিক্ত হন জহির শাহ এর এক চাচাত ভাই মোহাম্মাদ দাউদ খান। তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দাউদ খান বৃহত্তর পশতু অধ্যুষিত দেশের স্বপ্ন দেখতেন যার একটা বড় অংশ পাকিস্তানের ভূমি। যা পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি করে। একই সাথে তিমি সামাজিক সংষ্কারের দিকে ঝুকছিলেন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়েতে চেয়েছিলেন।

১৯৬৪ সালে আবার সংবিধান সংসোধন করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষমতা জনগনের হাতে তুলে দেয়া হয়। সংবিধানের এ সংশোধনে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়। এর ফলে রাজ পরিবারের বাইরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ খুলে যায়। এ সময়ে আফগানিস্তানে দুটি রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি হয়। একটি কমিউনিস্ট অন্যটি ইসলামিষ্ট। ধারনা করা হয় কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের থেকেই এই দুটি ধারার উদ্ভব।

১৯৭৩ সালে কিং জহির শাহ ইতালি সফরে গেলে তার চাচাত ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান সেনাবাহীনির সহযোগিতায় রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন এবং নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষনা দেন। ফলে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে এবং জন্ম হয় রিপাব্লিক ওফ আফগানিস্তান এর।

এ সময়ে সারা বিশ্বই দুইটি ভাগে বিভক্ত। আফগানিস্তানের এক সীমান্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্য সীমান্তে আমেরিকার বন্ধু পাকিস্তান ও ইরান। আফগানিস্তান এই দুই শক্তির মাঝে একটা জোট নিরপেক্ষ দেশ। এমন একটি গুরুত্বপূর্ন সময়ে এমন কৌষলপূর্ন ভৌগোলিক অবস্থানে থেকে দাউদ খান জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদান করেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ন ভৌগলিক অবস্থান ও মূল্যবান খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যের কারনে দুই পক্ষই এখানে প্রভাব বিস্তার করতে মরিয়া ছিল।

এ সময়ে আফগানিস্তানে কমিউনিষ্ট পন্থিরা বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং দাউদ খান তার ক্ষমতা ধরে রাখতে কমিউনিষ্ট নেতাদের হত্যা করতে শুরু করে। তার এ স্বৈরাচারী আচরনের কারনে ১৯৭৮ সালে সেনা অভ্যুথানে স্বপরিবারে নিহত হন এবং আফগানিস্তানে রাজ পরিবারের শ্বাসনের অবসান হয় (এখানে বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে মিল পাওয়া যায়, ঘটনাও সমসাময়িক)। এ সময়ের ঘটনাপ্রবাহ সাউর বিপ্লব নামে পরিচিত। এই বিপ্লবের মাধমে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন পিডিপিএ (পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান) এর কমিউনিষ্ট নেতা নূর মোহাম্মাদ তারাকি।

এসময়ে আফগানিস্তান রাজা আমানুল্লাহ খান এর আমলের মত বড় একটি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে শুরু করে। নূর মোহাম্মাদ তারাকি লিঙ্গ বৈষম্য দূরিকরন, নারী শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মত প্রশংসনীয় কাজ করলেও সমস্যা শুরু হয় ধর্ম নিয়ে। তখন কমিউনিষ্ট নীতীতে ধর্ম একটি অপ্রয়োজনীয় অপ্রাসংগিক বিষয় হিসেবে মনে করা হত এবং নুর মোহাম্মাদ এই ধর্মহীনতার আদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন। যা আফগানিস্তানের ধর্মপ্রান মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। আফগান সরকারের এমন কঠোর কমিউনিষ্ট আদর্শের প্রচার কমিউনিষ্ট ও ইসলামিষ্ট মতাদর্শীদের (৬০ এর দশকে ২ টি ধারার উদ্ভব) দূরত্ব আরো বৃদ্ধি করে। ফলে শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে গৃহযুদ্ধ। এ সময়ে আবার দেশের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ডেমক্রেটিক রিপাব্লিক অফ আফগানিস্তান। পতাকাও কমিউনিষ্ট লাল রঙ দ্বারা পরিবর্তিত হয়। সরকারের এসব কঠোর সিদ্ধান্ত, জন অসন্তোস ও গৃহযুদ্ধের ফলে কমিউনিষ্ট পার্টির মধ্যেও ভাঙ্গন ধরে। ফলে মাত্র ১ বছরের মধ্যেই ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে নূর মোহাম্মাদ তারাকিকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন আর এক কমিউনিষ্ট নেতা হাফিযুল্লাহ আমিন।

হাফিযুল্লাহ আমিন ক্ষমতা গ্রহনের পর নূর মোহাম্মাদ তারাকির ধর্ম বিরোধী নীতিগুলি পরিবর্তন করেন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। তারপরেও ইসলামিষ্ট ও কমিউনিষ্ট পন্থীদের দূরত্ব কমেনি বরং গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকে। ফলে হাফিযুল্লাহ আমিন এর ক্ষমতাও নড়বড়ে থেকে যায়। ইসলামিষ্টরা যাতে ক্ষমতা দখল করতে না পারে সেজন্য ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরন করে এবং হাফিযুল্লাহ আমিন কে হত্যা করে। ফলে আফগানিস্তানে আবার সরকার পরিবর্তিত হয়। নতুন সরকার প্রধান নিযুক্ত হন বাবরাক কারমল। এদিকে ইসলামিষ্টরা প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে ফলে বাবরাক কারমল এর অধীনে আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপুল সেনা মোতায়েন করে।

সোভিয়েত বাহিনীর মোকাবেলায় আমেরিকা ও পাকিস্তানের সহায়তায় ইসলামিষ্টরা গঠন করে মোজাহিদ বাহিনী। এবং শুরু হয় ১০ বছর মেয়াদী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মোজাহিদিন লড়াই।

চলবে……
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২২ দুপুর ১২:০১
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×