কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্রসৈকতের ঝাউবাগান নিধনের ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীসহ ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে চার কোটি আট লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করা হয়েছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে গতকাল বুধবার দুপুরে টেকনাফ থানায় এ মামলা করা হয়।
মামলায় ৮৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। টেকনাফ রেঞ্জের শাহপরীর দ্বীপ বিট কর্মকর্তা হাসান আল তারিক বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
মামলায় টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আসামি করা হয়েছে নূর হোসেনের বড় ভাই সাবরাং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহেদ হোসেন, খাইর হোসেন, উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি এজাহার মিয়াসহ ৫০ জনের বেশি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থককে। অপর আসামিদের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সুলতান আহমদ ও সাবেক সদস্য ফয়েজুর রহমান।
বিএনপির নেতা সুলতান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা জীবন ঝাউগাছ রক্ষার আন্দোলন করলাম, আর এখন নিধন মামলার আসামি হলাম। ঝাউগাছ কাটার মূল হোতারা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে।’
আওয়ামী লীগের নেতা জাহেদ হোসাইন বলেন, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য একটি কুচক্রী মহল ঝাউগাছ নিধন মামলায় তিনিসহ তাঁর তিন ভাইকে আসামি করেছে। তাঁরা ঝাউগাছ নিধনের সঙ্গে জড়িত নন বলে তিনি দাবি করেন।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন চৌধুরী মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মামলার বাদী হাসান আল তারিক জানান, টেকনাফ সৈকতে ঝাউগাছ নিধনের ঘটনা তদন্তে গঠিত বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করেছে। তালিকায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের নাম রয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৫ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা-কর্মীর নেতৃত্বে ২০০ থেকে ৩০০ শ্রমিক সাবরাং মৌজার কাটাবুনিয়া, কচুবুনিয়া ও খুরেরমুখ এলাকার বিএস ২৮১৬৭ নম্বর দাগের ৫০ একরসহ তত্সংলগ্ন প্রায় ২৬০ একর চর ভূমিতে উপকূল রক্ষার জন্য বন বিভাগের করা ঝাউবাগানে ঢুকে ১৭ হাজার ৫০০টি গাছ কেটে নিয়ে যায়। বন বিভাগ ১৯৯৫ সালে গাছগুলো লাগায়। ১৯৯৯ সালের ২০ মে সরকার এই এলাকাকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে গাছ কাটা, মাটির পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বাঁধ নির্মাণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
মামলার এজাহারে ৩৫ একর বনের ১৭ হাজার ৫০০ গাছের বিপরীতে (প্রতিটি ৫০০ টাকা করে) ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা; ঝোপঝাড়, লতা, গুল্ম, হারগোজাকাটা, নুনইন্যা, উড়িঘাস, কাইলা লতা ইত্যাদি ধ্বংস বাবদ ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা; মাটি কেটে বাঁধ, স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে মাটির ভৌগোলিক আকৃতি বিনষ্টজনিত ক্ষতি ২২ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ টাকা; পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিনষ্ট, বন্য ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল বিশেষত বিচরণ ক্ষেত্র ও বংশবিস্তারস্থল ধ্বংস তথা জীববৈচিত্র্য ধ্বংস বাবদ ক্ষয়ক্ষতি ৭০ লাখ টাকা; ২৫ একরে রোপণ করা নয় হাজার ৫০০টি ঝাউগাছ কাটার বিপরীতে ক্ষতি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার; পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস বাবদ ক্ষতি ৫০ লাখ; ২৫ একর জমির মূল্য বাবদ ৫০ হাজারসহ মোট চার কোটি আট লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ টাকার ক্ষতি দেখানো হয়েছে।
৯ সেপ্টেম্বর দুই শতাধিক দুর্বৃত্ত টেকনাফ সৈকতের খুরেরমুখ, কচুবুনিয়া, কাটাবুনিয়া ও হারিয়াখালী এলাকায় বন বিভাগের করা আড়াই শ একরের ঝাউবাগানে ঢুকে প্রায় ২০ হাজার গাছ কেটে ফেলে। এ নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন দৈনিকে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকনাফ সৈকতের ঝাউগাছ নিধনযজ্ঞে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।
ঝাউগাছ নিধনের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এম এন সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গত ২০ সেপ্টেম্বর টেকনাফ সৈকত পরিদর্শন করেন। বিভাগীয় কমিশনার ঝাউগাছ নিধনযজ্ঞ দেখে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে ক্ষতিপূরণের মামলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
উপকূলীয় বন বিভাগ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এম এ খালেক জানান, সৈকতের ঝাউবাগান রক্ষায় ব্যর্থতার দায়ে টেকনাফ রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফাসহ চার বনকর্মীকে ইতিমধ্যে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সৈকতের অন্য ঝাউবাগান যেন দুর্বৃত্তরা কেটে নিতে না পারে, সে জন্য বনকর্মীদের সজাগ রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক গিয়াস উদ্দিন আহমদ জানান, কেটে ফেলা ঝাউবাগানের ২৬০ একর ভূমি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব জমিতে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ দণ্ডনীয় অপরাধ’ উল্লেখ করে একাধিক সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসাইন জানান, বন বিভাগের কর্মকর্তারা অনুসন্ধান চালিয়ে ঝাউগাছ কাটার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মামলায় অভিযুক্ত করেছেন। পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে। ইতিমধ্যে টেকনাফ থানার পুলিশ ঝাউগাছ কাটার সঙ্গে জড়িত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
ঝাউগাছ নিধনের ঘটনায় এর আগে বিডিআর, পুলিশ ও বন বিভাগ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় পৃথক তিনটি মামলা করে।
তথ্য-প্রথম আলো

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




