বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির সূচনা, বিস্তৃতি এবং অবদান ম্রিয়মান কোন ঘটনা নয়। এই গৌরবদীপ্ত ভূখন্ডে ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল প্রগতিশীল দর্শন তথা জীননের মননশীল স্তরায়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করার জন্য। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান সৃষ্টি, ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৯-র গণ অভ্যুত্থান, ১১ দফার আন্দোলন, স্বায়ত্বশাসনের স্বপক্ষে সংগ্রাম সর্বোপরি ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্র সমাজ শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরূদ্ধে নিজেদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত করে। তাই ছাত্ররাজনীতি একদিকে যেমন মানবিকতা ও সৃষ্টিশীলতায় উৎসারিত; তেমনি অভিন্ন সেই বোধে অনিবার্যভাবে অসুন্দর আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে শক্তিও বটে। একটি গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যর অশীদারিত্ব নিয়ে যে ছাত্র রাজনীতির উত্থান-তার স্বরূপ, পথ পরিক্রমায় তার সৌন্দর্যহানি, কিছু মৌলিক জিজ্ঞাসা এবং নির্দেশনায় আবর্তিত হবে এই নাতিদীর্ঘ রচনা।
গত তিন দশকে ছাত্র রাজনীতির চারিত্র্য ও গুণগমমান ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ৭৫ র পটপরিবর্তন, সামরিক শাসন সমূহ ছাত্র রাজনীতিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। উক্ত সময়ে ছাত্র রাজনীতি তার চিরায়ত গণমুখী ঐতিহ্য বিসর্জন নিয়ে ক্ষমতামুখী দৃষ্টিভঙ্গী দৃঢ়তর ভাবে ধারণ করতে শেখে। ছাত্র রাজনীতির এখন তাই আধিপত্য আর সম্পর্ক যোজন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত।
প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই লক্ষ্য যেকোন প্রকারে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। জনগণের কল্যান তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একটি সেকেন্ডারী ইস্যু হিসেবে বিবেচ্য। আর তাই রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন হবার দুর্নিবার মোহে ছাত্র রাজনীতি এদেশে অযাচিতভাবে আশ্যয় ও প্রশ্যয় পাচ্ছে।
এদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে দল বা গোষ্ঠির প্রতি ছাত্র সমাজ অধিকতর সমর্থন প্রদান করেছে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সে দলটিই শাসন ক্ষমায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাই প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই চায় তার ছাত্য সমর্থন অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করতে।
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির মূলতঃ আবর্তিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজকে ঘিরে। এবং সেখানে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধীদলের একচ্ছত্র প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। ছাত্র রাজনীতিতে যারা নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত তাদের শিক্ষার মান অনুল্লেখ্য, নিজ সংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে তারা অনভিজ্ঞ, সর্বোপরি তাদের অনেকেই সন্ত্রাসী কাজ-কর্মের সাথেওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবার আঞ্চলিক ছাত্র রাজনীতিতে অছাত্রের সংখ্যাই বেশী। পওভুত্ব বিস্তার, চাঁদাবাজি ও মাস্তানির সুবিধার জন্য অছাত্র এবং সন্ত্রাসীরা নেতৃত্বের পুরোভাগে থেকে কলকাঠি নেড়ে থাকে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে বাক বিতন্ডা ও সংঘর্ষের অন্যতম প্রধান দু'টি কারণ হলোঃ
১। হল দখর বা আধিপত্য বিস্তার; এবং
২। টেন্ডার ভাগাভাগি নিয়ে কোন্দল।
ছাত্র রাজনীতি বর্তমানে মূল রাজনীতি ধারার একটি অন্রতম নির্ধারক অংশ। তাই ছাত্র রাজনীতিকে তুলনামূলক ভাবে নবীন বা অসক্রিয় ভেবে বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতির চলমানধারা থেকে পৃথক করা যায়না। অনিবার্য ভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এমনকি শিক্ষকরাও ছাত্র নেতৃত্বকে অবৈধ সুযোগ সুবিধা প্রদান করে চলেছেন। এ দৃষ্টান্ত বিরল নয় যে, তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির কবলে পড়ে মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থী সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে। আজ তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির নামে অন্যায় অপকর্ম আর অনৈতিকতাকেই আঁকড়ে ধরছে। ছাত্রনেতারা তাই আর কেবল ছাত্রনেতা নয়, বরং এলিট ক্লাসের ক্ষমতাবান সদস্যও বটে। আর সে আদলে চিন্ত করলে কেবল ছাত্ররাজনীতি নয় বরং এর চেইন আব ইফেক্টে ক্রমশ শংকিত হয়ে উঠতে হয়।
মূলতঃ ১৯৯০ এর অব্যবহিত পরে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে ছাত্ররাই এদেশে জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে সাহসী ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে। তারা তাদের মেধা, মনন এবং চিন্তাভাবনায় সুন্দরকে স্বাগত জানিয়েছে। অসুন্দরকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ছাত্রদের সমাজ সচেতনতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীরূপ তাদেরকে জাতির আশা-আকাংখার কর্ণধার করেছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ছাত্রদের রাজনীতি করা নিয়ে আমরা সবাই দ্বিধান্বিত। আজ তাই প্রশ্ন উঠেছে যে ছাত্রদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? সাবেক একজন রাষ্ট্রপ্রধান এ প্রশ্ন তুলেছিলেন আবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন কারণ তিনি ও তার সরকার বিব্রত। ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের যুক্তিগুলো এরকমঃ
ছাত্র রাজনীতির পক্ষে যারা রয়েছেন তাদের বক্ত্ব্যের মূল সুরটিই আবর্তিত হয় অতীতমুখী স্মৃতিচারণে। তারা বলেন ছাত্র রাজনীতির গৌরবমাখা অবদানে ঋদ্ধ হয়েছে আমাদের ইতিহাস। একথা অবিসংবাদিত সত্য যে, জাতির সংকট ও বিপন্নতায় ছাত্রসমাজ সর্বদাই ত্রাণকর্তার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ছাত্র রাজনীতিকে যারা সমর্থন করেন তারা মনে করেন ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আজ যা ঘটছে তা কোনভাবেই ছাত্র রাজনীতি নয়। তাই তাদের ঐদিহ্যময় ধারাবাহিকতা রাখতে প্রয়োজন এর মৌলিক সংস্কার। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করারা মধ্যে এর সমাধান নিহিত নেই। ছাত্র রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা অতীতের মত ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকা উচিত এবং সে প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতিকে অবশ্যই সুস্থ ধারার ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের স্বপক্ষে ধারার মতেঃ ছাত্র রাজনীতি মানেই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বানিজ্য আর হর দখলের মত সব ন্যাক্কারজনক সব ঘটনা। গুটি কয়েক ছাত্রনেতা নামধারী সন্ত্রাসী ও তাদের অনুগামী দলের কাছে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বনাদী হয়ে থাকার রাজনীতি নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য নয়। ধর্মঘট, নিত্যনৈমিত্যিক গন্ডগোলে ক্লাশ বন্ধ হয়ে থাকার কারণে সেশন জট তৈরী হচ্ছে, দীর্ঘায়িত হচ্ছে ছাত্রজীবন। সে কারনেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়াই মঙ্গলজনক।
একথা বলা অনাবশ্যক যে, ছাত্র রাজনীতির অর্থ যদি সাধারণ ছাত্র - ছাত্রীদের অধিকার আদায়ের রাজনীতি হয়, সৃজনশীলতা বিকাশের পখ হয়, তবে সেক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি কোন ভাবেই অকাম্য হতে পারেনা। যেসব বিষয় ও সমস্যা ছাত্রজীবনে অহর্নিশি মোকাবেলা করতে হয় যেমনঃ শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, শিক্ষার মান ও পাঠক্রমের সময়পযোগী পরিমার্জন, আবাসিক সমস্যা, হলে খাবারের মান, লাইব্রেরী সমস্যা, খন্ডকালীন কর্মসংস্থান ইত্যাদিকে ঘিরে অধিকার চর্চা বা পথ নির্দেশনা কোনভাবেই দূষনীয় নয়।
আবার জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতির পতি প্রকৃতির ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থবহ অবদান রাখার নিমিত্তে ছাত্র সমাজ সমকালীন রাজনীতিকে চিন্তার খোরাক কিংবা আদর্শের পখ বাতলে দেবে এবং তাতে জাতীয় রাজনীতি সমৃদ্ধ হবে। এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, সার্বক্ষণিক রাজনীতি ছাতদের জন্য নয়। প্রাথমিক কর্তব্যে জ্ঞানার্জন বা ভাল ডিগ্রী নিয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া। লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি নয় - অর্থাৎ কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন বা অংশ সংগঠন না হয়ে ছাত্র রাজনীতিকে সক্রিয় হতে হবে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার আলোকে। মূল ধারার আনুগত্য নয় বরং নিজস্বতা থাকতে হবে। নগন্য সংখ্যক ছাত্র রাজনৈতিক দলের ধামাধরা হয়ে ছাত্র রাজনীতির দর্শন ও পথকে দুর্দশাগ্রস্থ ও সংঘাতময় করে তুলবে তা যে কোন দৃষ্টিতেই অনভিপ্রেত।
এখন সময় এসছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে অনুধাবন করার। এবং যৌক্তিকতার মাপকাঠিতে সবচাইতে শ্রেয় বিষয়গুলির আদলে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সার্বিক সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র রাজনীতির দিক নির্দেশনা নিয়ে অনেকভাবনাই রয়েছে তার কিছু উপস্থাপন করছিঃ
(ক) রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ছাত্রসংগঠন সমুহের তথাকথিত লেজুড়বৃত্তি সৃলভ যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে ছাত্র সংগঠনকে রাজনৈতিক দলগুলির দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের অশুভ প্রয়াস রুখতে হবে।
(খ) রাজনৈতিক দলগুলোর এইমর্মে সততা এবং স্বচ্ছতার অঙ্গীকার করা দরকার যে, তারা ছাত্র সমাজের বিবিধ সমস্যা সমাধানে যত্নবান হবেন।
(গ) ছাত্ররাজনীতিতে কেবলমাত্র ছাত্রদের অংশগ্রহণই নিশ্চিত করতে হবে।
(ঘ) ছাত্ররাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে বিশুদ্ধ করতে শিক্ষকদের অগ্রনী ভুমিকা পারন করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের জবাবদিহিতা ও দ্বায়বদ্ধতার ব্যবস্থা হতে পারে অন্যতম সহায়ক শক্তি।
(ঙ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যবস্থাপনাগত দিকে উন্নয়নের যথেষ্ঠ অবকাশ রয়েছে। ঝাত্র, শিক্ষক, বিশেষ ব্যক্তিত্বসমূহ, সর্বপরি সরকার এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
(চ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতীর ভিত্তিতে কেবলমাত্র মেধাবী এবং সৎ ছাত্রগণই ছাত্ররাজনীতিতে নেতৃত্বের পদ অলংকৃত করতে পারে।
চটজলদি ছাত্ররাজনীতির সম্পূর্ণ শুদ্ধিকরণ হয়ত অসম্ভব। কিন্তু এ ব্যাপারে বিভিন্ন পযৃায়ে করণীয় অনেক কিছুই আছে। এছাড়া স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে মুশীল সমাজের চিন্তাভাবনা ও দিক নির্দেশনা ছাত্র রাজনীতিকে যথাযথভাবেই পরিশীলিত ও গ্রহণযোগ্য করতে পারে।
আমরা ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে নই বরং ছাত্ররাজনীতিকে যে কোন মূল্যে তার অশুভ এবয় অনৈতিক ধারা থেকে ফিরিয়ে আনতে চাই। আমরা চাই, ছাত্ররাজনীতি নিয়ে চলমান রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হোক। যদি এমনটি প্রয়োজন পড়ে যে, সার্বিক কল্যানে ছাত্ররাজনীতি নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হবে, তবে তাও ওভবে দেখা হোক। সন্ত্রাসীর পরিচয় হোক সন্ত্রাসী হিসেবে আর ছাত্রের পরিচয় ছাত্র হিসেবেই -- কোন ভাবেই একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নয়। ছাত্ররাজনীতির এই সংকট মোকাবেলার সামর্থের উপর আমাদের ভবিষ্যত পথ চলা অনেকাংশেই নির্ভর করছে।
সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, উদ্দোগ ও আন্তরিকতায় ছাত্ররাজনীতির বর্তমান বিবর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটুক এই কামনা করছি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




