somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষ রাত

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাঝরাতে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। যে দরজা ধাক্কাচ্ছে, মনে মনে তার বাবার উদ্দেশে হাজারটা গালি ঝেড়ে মহাবিরক্তি নিয়ে দরজা খুললাম। দেখি তমাল দাঁড়িয়ে আছে। ওকে এই মাঝরাতে দেখে অবাক হলাম বেশ।
- কিরে, এত রাতে কোনখান থেকে আসলি?
- কোথা থেকে আসব আবার? বাসা থেকে।

এবার আমার চোখ কপালে উঠার পালা। বাবা মার একমাত্র ছেলে তমালকে ভীষণ শাসনে রাখা হয়। যদিও আমার বিশ্বাস তাকে শাসনে না রাখলেও সে এখনকার মত ভদ্র ছেলে হয়েই থাকত। কলেজে উঠার পর থেকেই আমরা সিগারেট খাওয়া শুরু করেছি। অতি উৎসাহী একজন গাঁজাও টেস্ট করেছে। কিন্তু ভার্সিটির প্রথম বছরে এসেও তাকে আমরা সিগারেট খাওয়াতে পারলাম না। “আরে দোস্ত” বলে যখন ওর দিকে আমরা সিগারেট এগিয়ে দেই, তখনি দুষ্টু টাট্টু ঘোড়ার মত ঘাড় বেঁকিয়ে সে বলে, “দোস্ত পারুম না, মা’র কাছে প্রমিজ করা।“ ওর এই কথা শুনে আমরা স্বাভাবিকই পিছিয়ে যাই। আমাদের সঙ্গে থেকেও তার ভদ্র ছেলে স্বভাবটা যায়নি। সমস্যা একটাই আছে তার, সেটা হল আমাদের ক্লাসের এক মেয়ের প্রতি সে প্রচণ্ডভাবে দুর্বল। আমাদের সাথে যা একটু-আধটু কথা-বার্তা হাসি-তামাশা করে, মনীষার কথা আড্ডায় উঠলে সে একদম ভিজে বেড়ালের মত চুপ হয়ে যায়। আর ওই মেয়ের সামনে গেলে তার যে কি অবস্থা হয়, তা সহজেই অনুমেয়। কত্তবার যে সে চেষ্টা করেছে মেয়েটাকে তার মনের কথা জানাবে!! কিন্তু তার সে আশা চির অধরাই রয়ে গেছে এখনও। প্রতিবারই তার সামনে গিয়ে সে ফিরে আসে পরবর্তী পরিনতির কথা চিন্তা করে।
সে প্রচণ্ড চাপা স্বভাবের, তাই মনীষাকে নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনার কিছুই আমরা জানতে পারিনা। তাকে একটু কম খোঁচাই বলে আমার সাথেই সবচেয়ে বেশি কথা শেয়ার করে সে। কিন্তু আমার মনে হয় যে, আমি তার চিন্তা-ভাবনার ১০% ও জানি না।

যাই হোক, ওকে আসতে দেখে বেশ অবাকই হলাম। অবাক হওয়া কাটতে না কাটতেই তার কণ্ঠ শুনলাম।
- দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবি, না ভিতরে আসতে দিবি?
- ও, আয়, ভিতরে আয়।
বলে তাকে ভিতরে আসার জায়গা দিলাম। ভিতরে এসেই সে ধপ করে আমার বিছানায় বসলো। বসে চারদিকে এমনভাবে তাকাতে লাগলো, যেন সে আজই এখানে প্রথম এসেছে। আমি আরও অবাক হলাম।
- কিরে, কি দেখিস?
- না, তোর থাকার জায়গাটা আসলেই সুন্দর।
- কেন, আগে কি খেয়াল করিস নাই নাকি?
- কি জানি। আগে হয়ত এরকম সুন্দর লাগে নাই। ওই, তোর কাছে সিগারেট হবে?

এবার আমি আরও বেশি অবাক হলাম। যে ছেলেকে এতদিন সিগারেট খাওয়াতে পারিনি, সে কিনা আজ নিজ থেকে সিগারেট চাইছে।
- ওই সত্যি করে বল তো তোর কি হয়েছে?
- কই, কিছু হয়নাই তো।
- না না না, আমি শিউর তোর কিছু হয়েছে। আমার সাথে সত্যি বল তো।
- আররে নাহ, সত্যি আমার কিছু হয়নাই। তোরা তো সবসময় বলতি যে সিগারেট না খেলে নাকি পুরুষ মানুষ হওয়া যায় না। তাই আজ একটু পুরুষ হওয়ার চেষ্টা করছি।
- তাই বলে এত রাতে!
- আচ্ছা, তোর কি কোন অসুবিধা হচ্ছে তাতে?
- না, অসুবিধা হবে কেন?
- তাহলে দে।
আমি আমার প্যাকেটের শেষ বেনসনটি তার হাতে দিলাম। আমি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। সিগারেটে প্রথম টান দিয়ে সে শুরু করল কাশি। সেই বলল,
- প্রথম তো, তাই এরকম হচ্ছে।
- হুম। আমার মত রেগুলার হলে অসুবিধা হবে না।

আমি বুঝছিলাম নিশ্চয়ই কোথাও কোন গড়বড় হয়েছে। আর ও যেরকম চাপা স্বভাবের, খোঁচা না মারলে পেট থেকে কিছুই বের হবেনা। আমি আমার কাজ শুরু করলাম।
- ওই তোর কি তোর মায়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে?
- নাহ।
- তাহলে কি হয়েছে, বল না।
- বললাম তো কিছু না।
- মনীষা কিছু বলেছে?
- ও আমাকে কিছু বলবে কেন?
- তাও ঠিক। কিন্তু মনে হচ্ছে তোর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।
- আরে ভাই বললাম তো কিছু হয়নাই আমার। এখন চুপ থাক।
আমি থামলাম। আর তাকিয়ে তাকিয়ে তার সিগারেট খাওয়া দেখতে লাগলাম। সে যে আজ প্রথম সিগারেট খাচ্ছে, তা তাকে একটা বাচ্চা ছেলে দেখলেও বলতে পারবে।
চুপ করে থাকতে ভাল লাগছিল না। আমিই প্রসঙ্গ পালটালাম।
- ওই, মনীষার খবর কিরে?
- ভাল।
- কিরকম ভাল?
- খুব ভাল।
- ওটা আবার কিরকম?
- ওই, ওর খবর দিয়ে তুই কি করবি?
- আহহা, বল না......
- ও বেশ ভাল আছে।
- আচ্ছা।
বুঝলাম, আজকে তার সাথে কথা বলে বেশী সুবিধা করা যাবে না। তার চেয়ে সে কিছু বললে বলুক। আজ আমি নীরব শ্রোতা। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না আমার।
- ওই গান শুনবি?
- তুই গান গাইতে পারিস?
- কি মনে হয়?
- আচ্ছা, দেখি, গা।
সে শুরু করল, “ছাইরা গেলাম মাটির পৃথিবী......জীবন খেলায় হারাইলাম সবই......বুকে জমাট বাধা অভিমান......হায়রে কি নিঠুর নিয়তির বিধান.........”। ওর গানের গলার জন্যই হোক, বা নিঝুম রাতের পরিবেশের কারনেই হোক, গানটা শুনতে খারাপ লাগছিল না।
নিজের অজান্তেই কখন যে তার সাথে গলা মিলানো শুরু করলাম, নিজেও জানি না। গানটা শেষ করতেই আমি বললাম, “আরেকটা গা না দোস্ত!”
- না দোস্ত, আর পারি না।
- ভালই তো গাইলি। এতদিন ছিলি কোথায় তুই??!!
- তোদের সঙ্গেই ছিলাম, কেন? আমারে এতদিন দেখিস নাই?
আমি একটু হাসলাম। সেও হাসল, তার সেই চিরাচরিত প্রাণহীন হাসি। বলল
- দোস্ত তোর কাছে আরও সিগারেট আছে?
- না দোস্ত, নাইত......আর খাবি নাকি?
- হুম, ইচ্ছা করছে।
- ওই, প্রথমদিন এত খাইসনা......প্রবলেম হবে।
- ওকে......খাব না। আমি তাহলে যাই এখন।
- কোথায় যাবি? রাতটা এখানেই থাক।
- নাহ, আমার যেতে হবে......আমার জন্য ওরা অপেক্ষা করছে।
এবার আমি তার দিকে ভাল করে তাকালাম। তার চোখ দুটো অসম্ভব লাল।
- ওরা কারা? কাদের কথা বলছিস?
- তুই চিনবি না।
- ওই, তোর চোখ এমন লাল কেন?
- তোদের মত ‘পুরুষ’ হতে গিয়ে এ অবস্থা।
বলে হাসল সে। আমিও তার সাথে হাসলাম।
- আচ্ছা যা। ঠিকমত বাসায় যাইস।
- চিন্তা করিস না। তুই ঘুমা।
কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে তার চলে যাওয়া দেখলাম। বুঝলাম না যে তার মনে কি চলছে। কিছুক্ষণ এটা নিয়ে চিন্তা করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন তমালকে পাওয়া গেল আমাদের বাসায় একটু সামনেই; অর্ধনির্মিত এক পাঁচতলা বাসার সামনে। তাকে ঘিরে তখন লোকজনের ভিড়। যেন পৃথিবী থেকে চলে গিয়ে সে এক বিশাল সেলিব্রেটি হয়ে গেছে! আমি তার লাশের দিকে একবার তাকানোর পর আর দ্বিতীয়বার তাকাতে পারিনি। তাকাতে পারিনি তার মায়ের আহাজারি, বাবার নীরব কান্না, বা ছোট বোনের অশ্রুসজল মুখটির দিকে। আমি শুধু দেখছিলাম একটি ছেলেকে, যে কিনা তার মনের কষ্টগুলোকে সঙ্গী করে হারিয়ে গেছে দূর অকালের গর্ভে......হয়ত কোন না জানা সুখের আশায়।

মনে হয় আমি ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কেউই জানবে না তার শেষ রাতটির কথা। আর হয়ত আমিও জানব না তার না বলা দুঃখগুলোর কথা।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×