'৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী স্মরণে
- সৈয়দ আমিরুজ্জামান
এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মসহ এ দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যাখ্যান করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ ১৪ দল তথা মহাজোটকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করেছে। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি নতুন করে পরিবেশন করার সময় এসেছে; একইসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকেও তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাদের জানাতে হবে, "বাঙালি জাতি ও জনগণের বড় ও শ্রেষ্ঠ অর্জন এই মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের ইতিহাস হলো স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। এ দেশের মানুষ লড়াই করেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। দেশীয় সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচার ও লুটেরা শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। জনগণের সংগ্রামের মুখেই একদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ চলে গেলেও আমাদের উপর চেপে বসল পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক ধরণের শাসন ও শোষণ।
বাংলাদেশের মানুষ প্রথম থেকেই জাতিগত শাসন-শোষণ-বঞ্চণা-অনুন্নয়ন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে- যার চূড়ান্ত রূপ লাভ করল '৭১-এর সুমহান সশস্ত্র স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ভিতর দিয়ে। অল্পসংখ্যক ঘাতক রাজাকার-আল বদর-আল শামস-শান্তি কমিটির সদস্য ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস-নারী-পুরুষ-আবাল বৃদ্ধ বণিতা-দলমত নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ (বর্তমানে আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদ), মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ভাসানী), অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (মোজাফফর), কমরেড মণি সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিষ্ট পার্টি, কাজী জাফর-রাশেদ খান মেনন-হায়দার আকবর খান রনো'র নেতৃত্বাধীন কমিউনিষ্ট পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি (বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি), ছাত্র ইউনিয়ন [মেনন]-(বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী), ছাত্র ইউনিয়ন [মতিয়া]-(বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন)সহ অন্যান্য বামপন্থী প্রগতিশীল নানা গ্রুপ-দলের নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ফলেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘটলো এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটলো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণের শিকার জনগণের আংশিক বিজয় অর্জিত হল। কিন্তু যুগযুগব্যাপী এ দেশের কৃষক-শ্রমিকসহ অন্যান্য মেহনতী ও সাধারণ জনগণ শ্রেণী শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির যে আকাঙ্খাকে বুকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে এসেছে, সে আকাঙ্খা পূর্ণ হয় নি। স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত ৩৮ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখছি যে, সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর স্বজাতিয় দুর্নীতিবাজ আমলা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া-লুটেরা ধনিক-বণিক তথা শোষক শ্রেণীর রাজনীতিক, যাদের শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি-অনিয়ম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই চলছে।"
আমাদের বুঝতে হবে, কোন আদর্শ এবং বিশ্বাস থেকে জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কোন ভালোবাসা থেকে, দেশের মাটি থেকে বিদেশী শত্রুদের উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন, অনেকে গত ৩৮ বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখা আমাদের দায়িত্ব, যেহেতু একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের পরিচিতি তাঁরাই নির্মাণ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব করে গেছেন।
আমার ছোট খালু বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত ইয়াকুত চৌধুরীর বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ছিলেন এ রকম এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। আজ তাঁর ১৮তম মৃত্যুদিবস। মাত্র ৫৮ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। যদিও চিরঞ্জীব কিছু আদর্শ আমাদের জন্য তিনি রেখে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি হবিগঞ্জে অসীম সাহসের সঙ্গে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনা দলের মোকাবিলা করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি হবিগঞ্জ-চুনারুঘাট নির্বাচনী এলাকা থেকে জয়ী হয়েছিলেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি এলাকার মানুষের খুব নিকটজন ছিলেন। কাজেই তাঁর পক্ষে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা কঠিন কিছু ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতেই তিনি হবিগঞ্জের আনসার বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। একদিকে আনসার বাহিনী (যদিও এ বাহিনীর হাতে গোলাবারুদ ছিল সীমিত) অন্যদিকে হবিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণ- এই দুই শক্তিকে সংগঠিত করে মানিক চৌধুরী কয়েকটি ফ্রন্টে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধের শুরুতে মৌলভীবাজারের শেরপুর ফেরিঘাটে শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণে তিনি একজন অভিজ্ঞ সমরপতির ভূমিকাতেই নেমেছিলেন। পরে পাকিস্তানিরা সংগঠিত হলে এবং বিমান আক্রমণ শুরু করলে তিনি ভারতে চলে যান, এবং সেখান থেকেই যুদ্ধ চালিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধে এভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রেরণা তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁকে এলাকায় ফিরে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছিলেন। চা-বাগান শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে তীর-ধনুক তুলে দিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর সাংগঠনিক দক্ষতা ও ক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। ব্যক্তিগত জীবনে সদালাপি এবং নিরহঙ্কারী এই মানুষটিকে অল্প চেনা একজন মানুষও বিশ্বাস করতে পারত। তাঁর সততা ও স্পষ্টবাদীতাও ছিল সুবিদিত।
তাঁর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র হিসেবে। ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেতা হিসেবে তিনি বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামে ছিলেন সম্মুখ সারিতে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও তিনি ছিলেন একজন সৈনিক।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী হবিগঞ্জের মাধবপুরের কৃষকদের সেচের পানির ব্যবস্থা করার জন্য 'শ্যামল প্রকল্প' নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন। প্রকল্পটি শুধু সফলই হয়নি, এলাকার কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ধানের ফলন বৃদ্ধিতে এর প্রত্যক্ষ অবদান ছিল। আরও অনেক কিছু তাঁর পক্ষে করা হয়তো সম্ভব ছিল যদি কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হতো অথবা ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তন না হতো। কিন্তু তিনি ক্ষমতা থেকে দূরে থাকাকেই পছন্দ করেছিলেন। একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তিনি সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। শেষ দিকে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই চলে যান।
কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর সঙ্গে আমার অজস্রবার দেখা হয়েছে এবং আমি তাঁকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে শ্রদ্ধা জানাই এবং সেই শ্রদ্ধা এখনো লালন করি। তবুও আমার প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধকে এবং বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মানুষ কি ভুলে যাচ্ছে? তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল দরাজ, তাঁর হাসিটি ছিল মনে রাখার মতো। সেই দরাজ কণ্ঠে তিনি আমাকে আশীর্বাদ করেছিলন।
আজ কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ আমাদের সামনে আছে। যে আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে দেশপ্রেম, মানবিকতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্ম নিরপেক্ষতা। এই সময়ে এই আদর্শের চর্চা খুব জরুরি।
কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর আদর্শ দীর্ঘজীবী হোক।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




