পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)
পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, 'ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন।' (সূরা আম্বিয়া, ১০৭) অর্থাৎ আমি সমগ্র সৃষ্টির জন্য আপনাকে রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।
পৃথিবীতে হুজুরে পাক হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের-এর শুভ আগমন সব নিয়ামতের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। রাসুলে পাক (দ.)কে দুনিয়াতে প্রেরণের শুকরিয়া আদায় হিসেবে আমরা সুন্নি মুসলমানরা প্রতি বছর পবিত্র ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করি। রাসূলে পাকের পবিত্র জন্মদিনে আমরা তাঁর পবিত্র জন্মবৃত্তান্ত, জীবনবৃত্তান্ত, নূরে মোহাম্মদির কেরামতের আলোচনা, শানে মোস্তফা ও প্রাসঙ্গিক শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনকে আলোকিত ও গড়ে তোলার প্রয়াস পাই। শুকর আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর রেজামন্দি হাসিল করতে পারি। এরশাদ হয়েছে 'লা ইনশাকারতুম লা আজিদান্নাকুম'। অর্থাৎ তোমরা শুকর গুজার কর তবে আমি তা (রহমত) বৃদ্ধি করে দেব।
হজরত মূসা (আ.) বলেছেন, 'হে আল্লাহ আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি দস্তরখানা প্রেরণ করুন। যাতে এটা আমাদের আগে পরে সবার জন্য ঈদে পরিণত হয়।' সামান্য তুচ্ছ খানা প্রার্থনা ও প্রাপ্তি যদি ঈদ উদযাপনের উপলক্ষ হিসেবে আল্লাহ স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন তবে সমগ্র জগতের সৃষ্টির লক্ষ্য রাহমাতুল্লিল আলামিনের পৃথিবীতে প্রেরণ অবশ্যই তার থেকে উত্তম এবং বড় নেয়ামত। এজন্য তাঁর পবিত্র বেলাদতের দিনও ঈদের মতো। তাঁর শান এত ঊর্ধ্বে যে স্বয়ং রাব্বুল আলামিন বলেছেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নবীর ওপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাকুল আল্লাহর নবী ও রাসুলের উপরে দরূদ পড়েন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ এবং যথাযথভাবে সালাম পাঠ কর।' (সূরা আহ্যাব ৫৬)
হজরত ঈসা (আ.) বলেছেন, 'আমি এমন রাসূলের শুভ সংবাদদাতা, যিনি আমার পরে তশরীফ আনবেন, যার পবিত্র নাম আহমদ।' অর্থাৎ মিলাদে নবী মুস্তফা অন্যান্য নবীদের জন্যও সুন্নত। স্বয়ং হুজুর (সা.)ও মিম্বরে দাঁড়িয়ে সাহাবাগণের সমাবেশে নিজ বেলাদত ও গুণাবলী বর্ণনা করেছেন।
সাহাবায়ে কেরামগণ একে অপরের কাছে গিয়ে রাসূলে পাকের নাত শোনার আবদার করতেন এবং রাসূলে পাকের বেলাদত নিয়ে গবেষণা করে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করতেন। আবু লাহাবও রাসূলে পাকের পবিত্র জন্মদিনে ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্ম সংবাদ শুনে শুয়াইবা নামক দাসীকে আযাদ করায় প্রতি সোমবার তার কবর আজাব শিথিল করা হয়েছে। (বুখারি শরিফ ২য় খণ্ড, কিতাবুন নিকাহ)
তাহলে আমরা যদি এ মহান রবিউল আউয়ালে ঈমানদাররা একত্রিত হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি তবে আল্লাহ কি পুরস্কার দেবেন তা সহজেই অনুমেয়। শায়খ মুহাম্মদ জাহির রবিউল আউয়াল প্রসঙ্গে বলেন- ‘নিশ্চয়ই এটি এমন একটি মাস, যে মাসে প্রতি বছর আনন্দ প্রকাশ করার জন্য আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।' (মুজমাউল বিহার, পৃষ্ঠা ৫৫০)
ইমাম জালালুদ্দিন সয়ুতী (রা.) বলেছেন, 'হুজুর আলাইহিস সালামের বেলাদতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করা আমাদের জন্য মুস্তাহাব।' (তাফসিরে রুহুল বয়ান ৫ম খণ্ড, ৬৬১ পৃষ্ঠা)
আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রা.) তাঁর রচিত মাসাবাত মিনাচ্ছুন্নাহ গ্রন্থে লিখেছেন, 'হাজার মাসের চেয়ে উত্তম লাইলাতুল ক্বদর, ফজিলতের রাত্রি শবে বরাত, শবে মেরাজ, দুই ঈদের রাত। এসবই রাসূলে খোদাকে দান করা হয়েছে। যাকে দান করা রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম স্বয়ং তার আগমন দিবস যে কত লক্ষ কোটি দিবস রজনীর চেয়ে উত্তম তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।'
হজরত শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দেস দেহলভী (র.) বলেন, 'রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে পূর্ব নিয়ম অনুযায়ী সব লোকজন সমবেত হয়ে দরূদ পাঠে মনোনিবেশ করে। এরপর এই ফকির নিজে উক্ত মজলিশে উপস্থিত হই।'
হজরত হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী (র.) তাঁর রচিত হাফত মাসয়েলে লেখেন, 'এ ফকিরের নিয়ম হল আমি মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করে থাকি বরং মিলাদ অনুষ্ঠানকে বরকত লাভের উপায় বিবেচনা করে আমি প্রতি বছর মিলাদের আয়োজন করে থাকি এবং এ অনুষ্ঠানে কিয়ামের সময় অশেষ আনন্দ ও আরাম উপভোগ করে থাকি।'
আল্লামা ইবনুল জায়রী (র.) বলেন, 'মিলাদ অনুষ্ঠান হলে শয়তানের পিঠে কষাঘাত পড়ে, আর ঈমানদারদের হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়।' (সীরাতে শামীয়া)
বিশ্ববিখ্যাত আলেম মোল্লা আলী কারী (র.) ইমাম সাখাবী (র.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, 'যারা কয়েক বছরব্যাপী মক্কা শরিফে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিলাদ ও বরকতের পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন আমি তাদের মধ্যে অন্যতম।' (রেসালাতুল মাওরেদ)
হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, 'হুজুরে পাক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর দরূদ পড়ার ফলে গুনাহ এমনভাবে মিটিয়ে দেয়া হয়; যেভাবে ঠাণ্ডা পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। তার প্রতি সালাত সালাম পেশ করা দাসদাসী মুক্ত করার চেয়েও উত্তম।' (শেফাশরিফ- ২/৬১)
তাই আল্লাহতাআলা যথার্থ ইরশাদ করেছেন, 'ক্কুল বি ফাদলিল্লাহে ওয়া বিরাহমাতিহী ফাবিজ্বালিকা ফালয়াফরাহু।' অর্থাৎ 'আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের ব্যাপারে বেশি করে আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ কর।' (সূরা ইউনুছ আয়াত ৫৮)
হুজুর পাক আল্লাহর অনুগ্রহ এবং রহমতও। সেজন্য তার পবিত্র বেলাদতের জন্য আনন্দ প্রকাশ করা এ আয়াত অনুযায়ী আমল হিসেবে প্রকাশ পায়। এখানে আনন্দ উল্লাস বলতে সর্বপ্রকার সুশৃঙ্খল জামাতবদ্ধ বৈধ আনন্দ; যেমন মিলাদ মাহফিল, কেয়াম, জুলুস, হামদ-নাত, তবারক বিতরণ, দান খয়রাত ইত্যাদি সব কিছুকেই বুঝিয়েছে।
পবিত্র ঈদ-ই মিলাদুন্নবী উদ্যাপনই দিতে পারে মুসলিম উম্মাহর সৌভ্রাতৃত্ব ও একত্বের সন্ধান; যার মাধ্যমে আমরা দীন ইসলামকে নিয়ে যেতে পারব সর্বোচ্চ অবস্থানে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




