রাস্তার ফুটপাথ এর ধারে আইল্যান্ড এর উপর বসে আছে অনিত।প্রচন্ড ঠান্ডা,কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ।রাত বোধই ১টা বাজে।ঘড়ি নেই সাথে যে সময় দেখবে।ফোন চালু করে কয়টা বাজে দেখতে ইচ্ছা করছেনা ওর।বাজুক যতো খুশি..
ঠান্ডা বাড়ছে,একটু একটু করে কাঁপছে অনিত।কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই ওর।ঠায় বসে আছে এভাবেই।সারারাত এভাবেই বসে থাকার ইচ্ছা।রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে ও.এখন আর বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছেনা..রোজ রোজ এক ই জিনিস দেখতে কারর ই ভালো লাগেনা।অনিত ও তার ব্যাতিক্রম না। .
আজ অনিত এর বিয়ে।বিয়ে করার কোনো মন মানসিকতা ওর ছিলনা।কিন্তু ওর বাবা এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দিচ্ছে।কার সাথে বিয়ে হচ্ছে সেটাও জানেনা।মেয়েটির চেহারাই দেখেনি অনিত।দেখবে কেন,ও তো বিয়েই করবেনা।.ওর মতো ভবঘুরে,বাউন্ডুলে ছেলে বিয়ে করে সংসারি হবে এটা ও নিজেই ভাবতে পারেনা।একটা মেয়েকে অনিত ওর সাথে জড়িয়ে সারাজীবন তার ভার বহন করা ওর পক্ষে সম্ভব না। তাই একপ্রকার জোর করেই বের হয়ে গেছে ও বাসা থেকে। .
ফুটপাথ দিয়ে একটা নেড়ি কুকুর হেটে যাচ্ছে।অনিত এখন কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে।কুকুরটা যেন এই সময়ে একটা মানুষকে এভাবে একা বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালো।আচ্ছা,কুকুরদের চেহারাতেও কি অনুভুতি প্রকাশ পায়?নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো ও।উত্তর জানেনা,জানার কথাও না..
কুকুরটা হেটে হেটে চলে যাচ্ছে..অনিত ঘাড় ঘুরিয়ে কুকুরটার চলে যাওয়া দেখছে। নির্জন রাস্তায় এই সময়টায় অনিত এর পরে এই কুকুরটাই একটা প্রানি ছিলো।এখন অনিত একা।কোথাও ও ছাড়া আর কোনো প্রানী নেই..বাসার সবাই এখন কি করছে ভাবার চেষ্টা করলও ও।,বাবা হয়ত বারান্দার এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করছে আর রাগ এ ফেটে পড়ছে।বলছে "এই ছেলেকে আর ঘরে ঢুকতে দিবো না।এই ছেলে আমার মুখে চুনকালি মেখে পালিয়েছে,তোমারা কেউ ওর খোঁজ্ করবেনা"।মেয়েবাড়ির লোকেরা হয়ত ২ একটা কটু কথা শুনিয়ে চলে গেছে।বিয়ে বাড়ি থেকে মেয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক আছে,কিন্তু বিয়ের স্বয়ং বর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা সচরাচর ঘটেনা।আচ্ছা,মেয়েটা কি করছে?নিশ্চয় ওকে মনে মনে হাজারটা গাল'মন্দ করছে। .আপন মনেই হেসে উঠল অনিত। .
-অনিবাবু!
নিজের নাম শুনতে পেরে সংবিত ফিরে পেল অনিত।ওর সামনে বেলালচাচা দাড়িয়ে।বেলালচাচা ওদের বাসার মালী।ছোটবেলা থেকেই অনিত তাকে তাদের বাড়িতে দেখছে। এতবছরে চেহারার একটুও পরিবর্তন হয়নি তার।শক্তসমর্থ শরীর।গায়ে প্রচন্ড শক্তি রাখে বোঝাই যায়।ছোটবেলা বাবা যখন তার কাজে ব্যাস্ত থাকত,তখন এই বেলাল চাচাই অনিত কে দেখাশোনা করতো।সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান অনিত.বাবা ছেলেকে তেমন সময়ও দিতে পারেনা।ওর মা ওর বাবার সাথে ঝগড়া করে হঠাত করেই আত্ত হত্যা করে।অনিত তখন মাত্র ৪ বছরের শিশু
।
বাবা ব্যাস্ত থাকে সবসময়।বেলাল চাচাই বলতে গেলে ওকে মানুষ করেছে।লোকটার উপর অনিত এর একটা টান আছে..
-এখানে কি করো চাচা?
-বাড়ি চলো।
-তুমি ভালো করেই জানো আজ আমি বাড়ি যাবনা। তবুও বলছো কেনো?
-আমার জানা লাগবেনা। তুমি চলো।মালিক বলেছেন তুমি যেতে না চাইলে জোর করে তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে।আর তুমি ভালো মতই জানো কাজটা আমি করবো। তাই কথা বাড়িও না।
হো হো হো করে হেসে উঠলো অনিত।হাসি যেন থামছেই না।বেলাল চাচার মুখে কোনো বিকার নেই।চুপচাপ ঠায় দাড়িয়ে আছে। নির্বিকার।মাঝে মাঝে অনিত এর তাকে অনুভুতি শুন্য মনে হয়।এমন একটা মানুষ যে কিনা কখনো চমকায় না,অবাক হয়না,রোবট এর মতো চলাফেরা করে।মুখে কোনো অনুভুতি প্রকাশ পায়না.তাকে অনেকবার রাগানোর,চমকানোর সবধরনের চেষ্টা করেছে অনিত।কিনত সফলও হয়ওনি একবারও।
-মেয়েবাড়ির লোকেরা চলে গেছে?
জবাব দিলোনা চাচা।অনিত জবাব এর আর অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়ালো।মনে মনে তৈরি বাসায় যেয়ে গালি শোনার।হাটা শুরু করলো।আগে আগে চাচা হেটে যাচ্ছে।এই মানুষটার সাথে অনিত কখনই তাল মিলিয়ে হাটতে পারেনা।ওর কাছে মনে হয় বেলাল চাচা যেন বাতাসে উড়ে উড়ে চলে।হাঁটার সময় কোনও শব্দ হয়না। তাই মাঝে মাঝে অনিত এর বেড়াল এর কথা মনে পড়ে যায়।বেড়াল এরকম নিসশব্দে চলাফেরা করে। তাই ছোট বেলায় অনিত বেলাল চাচার নাম দিয়েছিলো "বেড়াল চাচা". কথাটা মনে পড়ে গেলো হঠাৎ.
অনিত যে ভেবেছিল বাসায় ঢুকে তার সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশ দেখবে ভাবেনি।অনিত এর বাবা আর কাজি সাহেব সোফায় বসে কথা বলছে।পাশেই এক হাত লম্বা ঘোমটা দেয়া লাল শাড়ি পড়া এক মেয়ে বসা।একটু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে অনিত।ও ভেবেছিল মেয়েবাড়ির লোকজন চলে যাবে।কিন্তু মেয়ে এখন আছে। তবে আশে পাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।হয়ত পাশের ঘরে আছে।মাথার ভেতর অনেকগুলো চিন্তা এসে ভর করলো।চাচার সাথে এতসহজে আসতে রাজি হয়ে ঠিক করেনি ও।বাবা ওকে দেখে কথা থামিয়ে দিলেন।
-অনিত,এদিকে এস।
-না।
-না মানে?আমাই আসতে বলেছি এস।আর একটাও কথা না।
-আমি বিয়ে করবো না বাবা।আপনারা আর জোর করবেন না।.
কথা শেষ হউয়ার আগেই বেলাল চাচা ওর পিছনে এসে দাঁড়ালো।এক হাত দিয়ে অর ঘার ধরে ধাক্কা দিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।হতভম্ব হয়ে গেছে অনিত।কিছুই করার থাকলো না ওর আর। . .
খাট এর উপর মেয়েটা বসে আছে।মাথা নিচু।অনিত ঘরে ঢুকে একপলক তাকালো মেয়েটার দিকে।চেহারা দেখা যাচ্ছেনা এখনো..অনিত যেয়ে কাবার্ড খুলে মদ এর বোতল বের করলো।এই একটা জিনিস অর প্রিয়।আপন।প্রচুর পরিমানে মদ খায় অনিত।কিন্তু কখনো মাতাল হয়না..সর্বোচ্চ হাত পা কাপে।কিন্তু এর বেশি কিছু হয়না ওর।
-এম্মা!আপনি মদ খান!
পেছন থেকে হঠাৎ রিনরিনে গলার কথা শুনে একটু বিরক্ত হয়ে তাকালো অনিত।মেয়েটা ঘোমটা সরিয়ে ফেলে ওর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।.
(চলবে)