somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিউ ইয়র্কে দেড় দিন

২১ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নিউ ইয়র্ক ভ্রমণের পরিকল্পনায় শহর দেখাটা উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল স্কুল জীবনের বন্ধুদের সাথে দেখা করা। স্টিল আর শক্ত কাচে ঢাকা গগনচুম্বী দালানের পাশে, ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, কোনো উদ্যানের পাশে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়া, বা কফিশপে বসে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারণ করাটাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া গেল গত মাসের শেষে দেড় দিনের নিউ ইয়র্ক ভ্রমণে।

নিউ ইয়র্কে পৌঁছানোর কথা রাত সাড়ে নয়টায়, কিন্তু ফ্লাইট বিলম্ব থাকায়, রাত পৌনে এগারোটায় পৌঁছালাম। বিমানবন্দরে নামতেই বন্ধুর বার্তা পেলাম - ব্যাগেজ ক্লেইম এরিয়াতে অপেক্ষা করছে। ব্যস্ত বিমানবন্দরে নেমে যদি দেখেন, আপনার বন্ধু আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, তাহলে ধরে নিতে পারেন, আপনার মানবজন্ম যদি বিফল হয়েও থাকে, বন্ধু-জন্ম সফল।

আটলান্টিক মহাসাগরের পারে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪০টি দ্বীপ নিয়ে এ মহানগর। শহরের বড় অংশ ম্যানহাটন, লং আইল্যান্ড ও স্টেটেন নামের তিনটি দ্বীপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। নিউ ইয়র্কের ব্যবসায়িক কেন্দ্র লোয়ার ম্যানহাটনের পাশের ব্রিজ ধরে আমরা যাচ্ছিলাম নদীর ওপারের প্রদেশ নিউ জার্সির একটি শহরে। গাড়িতে যেতে যেতে চোখে পড়ল নদীর পানিতে মিশে যাওয়া অন্ধকারে, ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াল স্ট্রিটের আকাশছোঁয়া দালানগুলো।

অন্য সব বড় শহরের মতো এখানেও রাস্তায় ট্রাফিক বেশি। মাঝে মাঝেই জ্যামে আটকা পড়ছিলাম। প্রতিদিন দশ লক্ষের বেশি মানুষ কাজের প্রয়োজনে নিউ ইয়র্কে যাতায়াত করে। তার উপর গ্রীষ্মের উইকেন্ড বলে আজ বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। বড় শহর মানে বড় বড় সব ভাণ্ডার - খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার, কাপড়-আসবাবপত্র- গাড়ির-যন্ত্রাংশের ভাণ্ডার, আবার অর্থের ভাণ্ডার, নথিপত্রের ভাণ্ডার। বিপুল তার সম্পদ, বৃহৎ তার টাকার থলে। বড় পুঁজি, বড় সঞ্চয় এখানে জমা হয়েছে। সেই পুঁজি বড় বড় প্রকল্পে লগ্নি হয়। শুধু এ শহরে নয়, পৃথিবীর আরও কত দেশে তাদের প্রকল্প আছে। আবার এই বড় পুঁজির লগ্নি চালাতে বহু মানুষের প্রয়োজন। সেই মানুষদের নিয়ে গড়ে উঠেছে শ্রমজীবী শ্রেণি।

কিছুদিন আগে আমার পরিচিত একজন, যিনি ইউরোপের একটি দেশে থাকেন, ফেসবুকে পোস্ট দিলেন যে তিনি ভ্যান গগের আঁকা বিখ্যাত চিত্রকর্ম স্টারি নাইট-এর একটি রিপ্রিন্ট কিনেছেন, যেটা সুদূর আমেরিকা থেকে তার বাসায় এসেছে। সেই পোস্টে আরেকজন প্রশ্ন করলেন - শিল্পীর বাড়ি তো তার বাসার কাছেই, তাহলে ছবিটি আমেরিকা থেকে আসার কারণ কী? ভ্যান গগের আঁকা অধিকাংশ ছবি তার দেশ নেদারল্যান্ডে সংরক্ষিত থাকলেও স্টারি নাইট রাখা আছে নিউ ইয়র্কের জাদুঘরে। ভ্যান গগ মারা গেছেন ১০০ বছরের বেশি আগে, সে হিসেবে তার শিল্পকর্মের কপিরাইট শেষ হওয়ার কথা আগেই। এখন যে কেউ ছবিটি ছাপাতে পারার কথা। খোঁজ করে জানলাম, কপিরাইটের মেয়াদ সাধারণ ছাপার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ঠিকই, কিন্তু হাই-রেজুলেশন প্রিন্টের জন্য এখনও নিউ ইয়র্কের জাদুঘরকে পয়সা দিতে হবে। বড় পুঁজির কী দারুন, অব্যর্থ কৌশল!

ঘড়ির কাঁটা যখন মধ্যরাতের কাছাকাছি, তখন বন্ধুর নিউ জার্সির বাসায় পৌঁছলাম। বন্ধুর সুখের নীড়ে তখনও তার স্ত্রী এবং তেরো বছরের কন্যা রাত জেগে অপেক্ষা করছিলেন। বন্ধুর বাবা-মা নিউ ইয়র্কের কুইন্সে থাকেন। সেখান থেকে তারা ছেলে ও ছেলের বন্ধুর জন্য বাংলাদেশি দোকান থেকে কিনে মিষ্টি পাঠিয়েছেন। বন্ধুর বাবা-মাকে দেখেছি বহুবার, কিন্তু সে ত্রিশ বছর আগের কথা। বন্ধুর স্ত্রী সর্ষে ইলিশ, মুরগির রোস্ট, রুই মাছের ঝোলসহ নানা পদ রান্না করেছেন। সেই সুস্বাদু খাবারগুলো গোগ্রাসে খেলাম ঠিকই, কিন্তু তাকে ধন্যবাদ তো দিলামই না, বরং কপট ভয় দেখালাম এই বলে যে, খাবারের আয়োজন এমন জমকালো হলে, সেটা আমি ফেসবুকে ফাঁস করে দেব!

পরদিন সকালে আমাদের স্কুল জীবনের আরেক বন্ধু, যে নিউ ইয়র্কের কাছে আরেকটি শহরে থাকে, আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তার শহর থেকে এই জায়গাটা আড়াইশ কিলোমিটারের পথ, তবু গাড়ি চালিয়ে সকাল সকাল চলে এসেছে। নাস্তার টেবিলে বসে যখন ভাবছি কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, তখন বন্ধু জানালো - তার বাবা আমাদের জন্য একটি ভ্রমণসূচি তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁর সুন্দর হাতে লেখা কল্যাণময় ভ্রমণসূচি ধরেই আমাদের যাত্রাপথ ঠিক হল।

বন্ধুটি হেলিকপ্টার কোম্পানিতে কাজ করে। সেখানে সে ফ্লাইট অপারেশনের প্রধান। নিউ ইয়র্কের ধনী ব্যবসায়ী, কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ ও বিখ্যাত ব্যক্তিরা হেলিকপ্টারগুলো কাজের প্রয়োজনে বা বিনোদনের জন্য ভাড়া নিয়ে থাকেন। হেলিকপ্টারে চড়ে নিউ ইয়র্ক শহর বা স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখাটা আমার কল্পনাতেও ছিলনা, কিন্তু শহর ঘুরে দেখা শুরু হলো হেলিকপ্টারে চড়ে। এই উপলক্ষে বন্ধুর কর্মক্ষেত্র দেখার সুযোগ হলো। তার টিমের কয়েকজনের সাথেও পরিচয় হলো।

হেলিকপ্টারের পাইলট স্ট্যাচু অব লিবার্টির বেশ কাছাকাছি গিয়ে আকাশে একটি মোচড় দিলেন। মনে হলো, আকাশ থেকে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখার যে স্বপ্নদৃশ্যে বিভোর ছিলাম, সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে আর ঘুম ভেঙ্গে বিছানা থেকে পড়ে গেছি। হেলিকপ্টার ভ্রমণ শেষে গন্তব্যে নামতেই রাস্তায় অনেক সাইকেল আরোহী নারী-পুরুষ দেখতে পেলাম। নিউ ইয়র্কের যান্ত্রিকতা সম্পর্কে মনে যে পূর্বধারণা তৈরি হয়ে ছিল, সাইকেল আরোহীদের দেখে সেটা কমে গেল।


তখন বেলা দেড়টা, আমরা ছুটলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে নাইন-ইলেভেন মেমোরিয়াল দেখতে। কালো সিমেন্টে বাঁধানো বড় পুল, পুলের ভিতরে কৃত্রিম জলপ্রপাত থেকে অঝর ধারায় পানি পড়ছে - এই হলো মেমোরিয়াল। তার দেয়ালের গায়ে সন্ত্রাসী হামলায় যারা মারা গেছেন, তাদের নাম লেখা। মেমোরিয়ালের পাশের উঠোনে সারি সারি বহু ওক গাছ। এই ওক গাছগুলো যখন প্রাচীন হবে, তখন চত্বরটির পরিবেশ অন্যরকম হবে - এমন মনে হল।


মেমোরিয়ালের কাছেই সাদা ডানাওয়ালা উড়ন্ত বক বা ফ্লেমিংগো পাখির মতো দেখতে দৃষ্টিনন্দন একটা দালান। পাশে ছোট ছোট কতগুলো স্থাপত্য। দালানের নাম ‘অকুলাস’। এক স্প্যানিশ স্থপতির ডিজাইন করা। অকুলাসের ভিতরে বিপণি বিতান। বাহিরে নান্দনিকতা আর ভেতরে ব্যবসা। বিপণি বিতান পার হয়ে কিছু দূর হেঁটে গেলে পাতাল রেলের স্টেশন - ব্যস্ত সাবওয়ে। এগুলো দিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ যাতায়াত করে।


সাবওয়ে ধরে আমাদের পরের গন্তব্য মধ্য-ম্যানহাটনের রেডিও সিটি হল ও রকেফেলার সেন্টার। রেডিও সিটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় থিয়েটারগুলোর একটি। অপেরা বা মঞ্চনাটকের জন্য তৈরি হলেও এখন এটি বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার হয়। এখানে ৬০০০ মানুষ সিনেমা বা অন্য কোনো শো একসাথে উপভোগ করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সেই গ্রামের বোকা পিতার কথা মনে পড়লো, ছেলে শহরে থাকে বলে যে খুব গর্ব করে, অথচ জানেন না যে শহরের সুবিধাগুলো সকলের জন্য সমান নয়। শহরের সুবিধা টাকা দিয়ে কিনতে হয়, সকলের সে সামর্থ্য থাকে না। এ শহরের কত শতাংশ মানুষ রেডিও সিটি হলে বসে বিখ্যাত শিল্পীর গান শুনেছেন - এইসব স্থাপনার নামফলকের পাশে যদি এই তথ্যগুলো থাকত, বেশ হতো।

রেডিও হলের পাশে রকেফেলার সেন্টার। এই সেই প্রবল সম্পদশালী জন, ডি. রকেফেলারের নতুন যুগের সাম্রাজ্য। বহুতল ভবনে তেল কোম্পানির হেড অফিস, পুঁজি-লগ্নি-চালানের দুর্গ। ভবনের বাইরে গ্রীক দেব-দেবীর দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। রকেফেলারের স্ট্যান্ডার্ড অয়েল বিগত শতকের শুরুতে পৃথিবীর আশি শতাংশের বেশি কেরোসিনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। ইডা টারবেল নামে একজন নারী সাংবাদিক স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের একচেটিয়া ব্যবসা সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধানী লেখা প্রকাশ করতে থাকেন। পরে বই হিসেবে প্রকাশিত হলে ব্যবসার ইতিহাসে খুব প্রভাবশালী বইয়ের তালিকায় সেটা স্থান করে নেয়। তার লেখা একদিকে যেমন অ্যান্টিট্রাস্ট নিয়ন্ত্রণ আইন পাসে ভূমিকা রাখে, তেমনি স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানিকে ভেঙে ৩৯ টি ভাগ হয়ে যেতে বাধ্য করে।

এখান থেকে আমরা গেলাম কাছের একটি চার্চে, নাম সেন্ট প্যাট্রিকস ক্যাথেড্রাল। সেদিন যদিও শনিবার, কিন্তু চার্চের ভিতরে বক্তৃতা ও প্রার্থনা চলছিল। ইউরোপের প্রাচীন কোনো চার্চের মতোই ভিতরের পরিবেশটি গুরুগম্ভীর। ভবনের ভিতরে দুপাশে খ্রিস্টীয় ইতিহাস শিল্পীর নিপুণ ভাস্কর্যে প্রকাশ পেয়েছে।

আমাদের পরের গন্তব্য ছিল টাইমস স্কয়ার। ডিজিটাল বিলবোর্ড ও বিজ্ঞাপনে ঘেরা জায়গাটি মিডটাউন ম্যানহাটনের প্রধান বাণিজ্যিক ও বিনোদন কেন্দ্র। এটি খুব ব্যস্ত একটি জায়গা, যেখানে বছরে প্রায় ৫ কোটি দর্শনার্থী ভিড় করে। এখানে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ আছে, যেখানে গানের বা অন্য অনুষ্ঠান হয়।

টাইমস স্কয়ার থেকে বের হয়ে আমাদের গন্তব্য ব্রুকলিন ব্রিজের কাছে নদীর ঘাটে। কিন্তু ট্যাক্সি যে জায়গায় নামিয়ে দিল, তাতে করে আমরা বুঝলাম যে ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। ম্যানহাটনের পূর্ব দিকে "স্টুই টাউন" নামের এই স্থানে ভুল করে এসে পড়েছিলাম বলেই আমাদের তিন বন্ধুতে অকারণে অনেকটা পথ হাঁটা হলো। হাঁটতে হাঁটতে আবাসিক এলাকাগুলোর পাশের উদ্যানে আমরা দাঁড়ালাম। কার ভুলে আমরা এই ভুল জায়গায় এলাম, এটা নিয়ে ঝগড়া করলাম, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলাম।


এই রাস্তায় হাঁটার সময় আমার হাতে দুজন মহিলা দুটি লিফলেট গুঁজে দিলেন। একটি কোনো এক বাইবেল সোসাইটির লিফলেট, অপরটি মেয়র নির্বাচনের প্রার্থীর লিফলেট। বন্ধু জানাল যে জোহরান মামদানি নামের দক্ষিণ-এশীয় বংশোদ্ভূত একজন প্রাইমারিতে অংশ নিয়েছেন। নামটি আমার পরিচিত, কিন্তু তিনি মাহমুদ মামদানি, একজন লেখক। আমেরিকায় নাইন-ইলেভেনের পরে লেখা তার বিখ্যাত বই "গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম" আমার দারুণ কৌতূহলের বিষয় ছিল। মাহমুদ মামদানির স্ত্রী তার চেয়েও বেশি বিখ্যাত। তিনি চলচ্চিত্রকার মীরা নায়ার। ঝুম্পা লাহিড়ীর লেখা বই “দ্যা নেমসেক” এর উপর নির্মিত তার সিনেমাটি আমি ঢাকায় থাকতে দেখেছিলাম। সেটা বোধহয় ২০০৭-০৮ সালের কথা। মীরা নায়ারকে নাকি "হ্যারি পর্টার" সিনেমা বানাতে অনুরোধ করা হয়েছিল। সেটা প্রত্যাখ্যান করে তিনি তখন “দ্যা নেমসেক” বানিয়েছিলেন। জোহরান মামদানি যে মীরা নায়ার ও মাহমুদ মামদানির ছেলে, তখন জানা ছিল না।

ব্রুকলিন ব্রিজের নিচে ফুলটন ফেরি বলে যেখানে এলাম সেটি পর্যটকপ্রধান জায়গা। ঘাটে বসে থেকে বিকেলটা বেশ গেল। সেখান থেকে কাছেই একটা ফেরিঘাট। কতগুলো বড় নৌকা ফেরিঘাট ছেড়ে যাচ্ছিল। বন্ধু প্রস্তাব করল নৌকা ভ্রমণের। টিকিট কেটে বোটে ওঠার লাইন অনেক লম্বা। নৌকাগুলো ঠিক ট্যুরিস্ট বোট নয়, সাধারণ লোকেরাও যাতায়াত করে। উপরের পাটাতনে ভিড় বেশি। যাত্রী বোঝাই বোট হাডসন নদীর উপর দিয়ে ছুটল। সূর্যের আলোর তেজ তখন কমে এসেছে, নদীর বাতাসটাও মন্দ নয়। আজ সারাদিন আবহাওয়া ছিল বেশ গরম। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় নদীর পাড়ের কাচে ঘেরা দালানগুলো অন্যরকম মনে হচ্ছে। নরম রোদের সাথে এগুলো আমার মনে সহনীয় হতে শুরু করেছে। নাগরিক এই দালানগুলো নিউ ইয়র্কবাসীর প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার অংশ, শহরের ঐতিহ্য, এক অর্থে নিউ ইয়র্কের হৃদয়!


বোট থেকে নেমে নিউ জার্সিতে ফেরার সময় আমার অপর বন্ধু জানালো যে আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে শক্তিশালী বোমা ফেলেছে।

বাসায় ফিরে সেদিন আমাদের জন্য স্পেশাল ডিনার অপেক্ষা করছিল। ভিতরে ভিতরে খুব লজ্জিত হলাম এই ভেবে যে,আমরা যখন ম্যানহাটনের রাস্তায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন বন্ধুর স্ত্রী রান্নার কষ্টকর কাজে ব্যস্ত ছিলেন।


রাতের খাবারের পরে একসাথে সকলে বসে গল্প করার সময় জানতে পারলাম, বন্ধুর মেয়ের পোষা কুকুরটি ক্যান্সারে আক্রান্ত। মেয়ের যখন দশ বছর বয়স, তখন তার আগ্রহে কুকুরটি বাড়িতে আসে। তখন থেকে প্রাণীটি এ বাড়ির সদস্য। গায়ের টিউমারের ক্ষত থেকে যে রক্ত পড়ে, তার শুশ্রূষার প্রয়োজন পড়ে। বন্ধুর স্ত্রী সেই কাজগুলো নীরবে সম্পন্ন করেন। ভেট ডাক্তার বলেছেন, যেন ইনজেকশন দিয়ে চিরস্থায়ীভাবে প্রাণীটির কষ্ট দূর করা হয়। কিন্তু সে কাজে বন্ধুর স্ত্রীর মন কিছুতেই সাড়া দেয় না। বেজমেন্টে রাখা অবলা প্রাণীটিকে দেখতে গেলাম। বন্ধুকে দেখলেই কুকুরটির অভিব্যক্তি কোমল হয়ে ওঠে। আমার দিকেও সে কোমল চোখ মেলে তাকিয়ে রইল।

আমাদের অপর বন্ধু সেদিন অনেক রাত করে বাসায় ফিরেছিল। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওর রাত প্রায় তিনটা বেজে গিয়েছিল।

পরদিন সকালে খুব বজ্রপাতের শব্দ আর তুমুল বৃষ্টি। বাজ পড়ার শব্দে বন্ধুর মেয়ে জানালো যে, সে ভয় পেয়েছে এই ভেবে যে ইরান বোধহয় আমেরিকায় বোমা ফেলেছে।

আমার ফ্লাইট বিকেল চারটায়। এয়ারপোর্টে যেতে হবে বেলা দুটোর মধ্যে। সকালে বন্ধু প্রস্তাব করল তার প্রিয় টার্কিশ রেস্তোরাঁয় গিয়ে নাস্তা করার। আমরা যখন রেস্তোরাঁয় পৌঁছলাম, তখন সবে তার দরজা খুলেছে। অন্য কাস্টমার তখনও নেই। বন্ধুটি এইচ.এস.সি.-র পরে আমেরিকা চলে এসেছিল। থাকত কুইন্সে। দিনের বেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করে বিকেলে সে রেস্তোরাঁর কাজে ঢুকত, কাজ করত গভীর রাত পর্যন্ত। কাস্টমারদের টিপসই ছিল তার আয়ের বড় অংশ। টাকা নিয়ে পাতাল রেলে বাড়ি ফেরার পথে কতবার যে ছিনতাইকারীর হাতে পড়েছে, সেই গল্প শোনাল। ছিনতাইকারী প্রথমে নম্রভাবে একটি ডলার চাইত, তারপর বাকি টাকা কেড়ে নিত। তাদের পাল্লায় পড়লেই সে দিত এক দৌড়। তখন বয়স ছিল ১৯-২০, দৌড় দিলে আর কে ধরে আমাকে, বলল বন্ধুটি।

নাইন-ইলেভেনের পরে, বন্ধু তখন নিউ ইয়র্কে ব্লুমবার্গে চাকরি করত, সেসময় চাকরি চলে গেল। নামের সাথে যেহেতু "ইসলাম" পদবি আছে, কেউ আর তখন চাকরি দিতে চাইত না। নাম নিয়ে লোকে হাসাহাসি পর্যন্ত করত - ধর্মের নাম আবার মানুষের নাম হয় কী করে! চাকরি নিয়ে এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে ছোটা - অন্য অভিবাসীদের মতোই বন্ধুর জীবনের যাত্রাপথ কঠোর পরিশ্রম, নিরলস প্রচেষ্টার ধারাবাহিক অধ্যায়। তবু এই সাধনার পথে অনিশ্চয়তার সংশয় কম্পন তোলে। বললো, ট্রাম্প নাকি সোশ্যাল সিকিউরিটি পেনশনটি বন্ধ করতে চাচ্ছে।

বিকেলে আমাকে সে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিল। এয়ারপোর্টের পাশের রাস্তায় বেশিক্ষণ গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার নিয়ম নেই। তবুও গাড়ি পার্ক করে আমরা ছবি তুললাম। আবার কবে দেখা হবে! তারপর ব্যাগ টানতে টানতে এয়ারপোর্টে মানুষের ভিড়ে মিশে গেলাম।

বিমান যখন আকাশে হাডসন নদীর মোহনার উপর দিয়ে উড়ছিল, আমি নিচের দিকে তাকিয়ে সেই বিশাল, বিপুল শহরটির দিকে চেয়ে রইলাম। মনে হলো, এই শহরের কোথাও, কোনো রাতের অন্ধকারে বন্ধুকে ছিনতাইকারী ধরেছিল। শহরের কোনো দালানের কাচে, কার্নিশে, পাতাল রেলের লাইনের পাশে, কিংবা কোনো দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে তাঁর সেই ভয়, সেই দৌড়ে পালিয়ে বাঁচার গল্পটি, তার জীবনের শোক দুঃখ হাসি কান্নার গল্পগুলি কোথাও লেখা আছে কি?


বিঃদ্রঃ প্রথম ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা, বাকি গুলো আমার মোবাইল ফোনে তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০২৫ সকাল ১১:৩০
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×