
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর আবার ভাঙতে যাবার অর্থ হলো, জামাত ও মৌলবাদীদের প্রতিপক্ষ হাসিনা, হাসিনার স্বৈরশাসন বা আওয়ামী লীগের গুম-খুন-লুটপাট নয়। তাদের প্রকৃত প্রতিপক্ষ মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙলা সংস্কৃতি। বাঙালি জাতির যে আত্মঅন্বেষণ ও সাংস্কৃতিক চেতনার উদ্ভাসন মুক্তিযুদ্ধে ঘটেছিল, সেই জায়গাটাই জামাতের বিরোধের মূল কেন্দ্র।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে যতটা সক্রিয় হয়েছে, অতীতে এমনটা দেখা যায়নি। জুলাই আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ - রিকশাচালক, গার্মেন্টস কর্মী, দিনমজুর, হকারসহ খেটে-খাওয়া মানুষ ছিলেন একেবারে সম্মুখসারিতে। রক্ত ও জীবন দিয়ে প্রথম মূল্য তারাই দিয়েছেন। কিন্তু হাসিনার পলায়নের পর সকল প্রকার আলোচনা থেকে প্রথমে তাদেরই বাদ দেওয়া হলো। হাসিনার পতনের সাথে সাথে আওয়ামী এলিটেরা পালালে জামাতের এলিটেরা ক্ষমতা দখল করলেন।
শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভবনের নাম পরিবর্তনের জোয়ার। ড. কুদরৎ ই খুদা ভবনের নাম বদলে রাখা হলো জাবির ইবনে হাইয়ান। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশ চন্দ্র বসু ও জীবনানন্দ দাশের নাম মুছে ফেলা হলো। আদর্শিক শক্তির প্রথম আঘাত পড়লো বাঙালি সংস্কৃতি এবং সেক্যুলার রাষ্ট্রচিন্তার ওপর।
জামাতের আমীর নেমে পড়লেন মেয়েদের পেছনে। কখনো তিনি মেয়েদের কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলেন, কখনো ঘরে থাকার জন্য ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তার কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তিনি নতুন করে দাসপ্রথা চালু করতে চান এবং নারীদের দাসী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতে চান। ভারতে যেমন দলিতদের ওপর নিপীড়ন চলে, মোল্লাতন্ত্রে তেমনভাবে নারীদের দাসী করে রাখার প্রথা। এসব অসলগ্ন কথার আড়ালে তিনি আসলে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার লিটমাস টেস্ট নিচ্ছেন। যার ফলফল সবসময়ই নারীর মুখে কালি মেখে দেয়া।
জামাত যদি ক্ষমতায় আসে, সমস্যা কী? সমস্যা হল, জামাত ধর্মভিত্তিক, জঙ্গিবাদী, বর্ণবাদী ও নারী-বিদ্বেষী রাজনীতি করে। তাদের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে বর্ণবাদ, ধর্মীয় গোড়ামি, কুসংস্কার ও মিথ্যাচারের ওপর। যেমন জায়নবাদের বিশ্বাস, ইহুদিরা শ্রেষ্ঠ জাতি, হিন্দুত্ববাদী আরএসএসরা উচ্চবর্ণবাদী, কিংবা নাজিদের আর্য শ্রেষ্ঠত্বের মতই জামাতের রাজনীতিও একই ধরনের মুসলমানী শ্রেষ্ঠত্ববাদী ধারণার প্রতিফলন।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যেমন বাঙালি সংস্কৃতিকে ঘৃণা করত, জামাতও একই মনোভাব বহন করে। ফলে তাদের সমস্ত কার্যক্রমই মূলত মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। জামাতের রাজনৈতিক কাঠামো পাকিস্তানি সামরিক ও অভিজাত শ্রেণির উত্তরাধিকারে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত। এটি বাঙালি হিন্দু- মুসলিম, বৌদ্ধ- খ্রিষ্টান-আদিবাসীদের রাজনীতি নয়। মানুষের অধিকার নয়, মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ধারণাই এখানে মুখ্য। তাই হত্যা, নিপীড়ন ও দমন-পীড়ন এদের রাজনীতির কেন্দ্র।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর "সংস্কৃতি-কথা" প্রবন্ধে লিখেছিলেন: ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম… কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা… বাইরের আদেশ নয়, ভেতরের সূক্ষ্মচেতনাই তাদের চালক।
দেখার বিষয়, বাংলাদেশে মননশীল ও উন্নত চরিত্রের বাঙালি সংস্কৃতির জয় হয়, নাকি রাজাকার-জঙ্গি-বর্ণবাদীদের ধর্মের নামে বানানো অধর্মের জয় হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


