somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাউল রবীন্দ্রনাথ ও লালন-বরীন্দ্রনাথ সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ

২৬ শে নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে রবীন্দ্রনাথ-লালন সাক্ষাৎকার নিয়ে আগ্রহোদ্দীপক একটি লেখা পড়েছিলাম। সাম্প্রতিক বাউল পেটানোকে কেন্দ্র করে লেখাটির কথা মনে পড়ায় সেটি খুঁজলাম। খোঁজাখুঁজি করে লেখাটি পেলাম না বটে, তবে আবুল আহসান চৌধুরী রচিত এবং বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত "লালন শাহ" - এই নামে খুব তথ্যবহুল একটি বই পেলাম। দেখা গেল দেশ পত্রিকার নিবন্ধটির অনেক অংশ এই গ্রন্থ থেকেই নেওয়া।

যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের বই সেরদরে বিক্রি করা হচ্ছে এবং বাউল পেটানোর রাষ্ট্র-অনুমোদিত দুষ্কর্ম শুরু হয়েছে, তাতে মনে হয় পরের ধাপে রবীন্দ্রনাথকে লক্ষবস্তু করা হবে। কারণ বাউল আর রবীন্দ্রনাথ খুব দূরের নয়। আর যেখানেই বাঙলা সংস্কৃতি, সম্প্রদায়-সম্প্রীতি এবং বৃহত্তর মানবধর্মের প্রেরণা বা উপাদান আছে, উগ্রবাদী ধর্মান্ধ এবং ধর্মব্যবসায়ীদের লক্ষবস্তু সেটাই।

আমরা জানি, বাউলগান রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু যে কথাটা শোনা যায়না তা হলো, বাউলগানের মতই, রবীন্দ্রনাথের গানও তখন বাংলাদেশে বা তৎকালীন পূর্ববঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয় ছিল। তিনি লিখেছেন, "বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি।" আরও লিখেছেন "আমার অনেক গান বাউলের ছাঁচের। সেগুলো স্পষ্টত রবীন্দ্র-বাউলের রচনা।"

"আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে" - গগন হরকরার এই বাউল গানটির সুর অনুসারে রবীন্দ্রনাথ "আমার সোনার বাংলা" রচনা করেন। তাঁর আরেকটি গান "আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে/ তাই হেরি তাঁয় সকলখানে"- গানটির কথা ও সুরও স্পষ্টই রবীন্দ্র-বাউলের রচনার আরেক উদাহরণ।

শিলাইদহে গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ ও লালনের শিষ্যসম্প্রদায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল। এদের কাছ থেকে তিনি লালনের গান শোনার সুযোগ পান। "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি " গানের ভাব রবীন্দ্রনাথকে খুব প্রভাবিত করেছিল। লালনের অচিন পাখির জিজ্ঞাসার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনজিজ্ঞাসার মিল আছে।

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৮৯০ সালে। ততোদিনে লালনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার আগেও বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকবার শিলাইদহে এসেছিলেন। সেই সময়ে লালনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হওয়া অসম্ভব নয়। সাক্ষাৎ না হলেও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে জানতেন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের দেখা হয়েছিল কি না, এটা নিয়ে পরস্পরবিরোধী দুটি ঘটনার কথা বইটিতে উল্লেখ আছে।

১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেন: "তুমি তো দেখেছো, শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগণের সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। তারা গরিব। পোশাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার যো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারত।"

এই কথাগুলো থেকে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ লালন নয়, বরং তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। লালনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় থাকলে সেখানে তাঁর কথা উল্লেখ করাই প্রাসঙ্গিক হতো। আবার নিচের তথ্য থেকে মনে হতে পারে যে উভয়েরই আলাপ-পরিচয় ছিল।

বসন্তকুমার পাল লালনজীবনী রচনার আগে রবীন্দ্রনাথের সহযোগিতা প্রার্থনা করে তাঁকে পত্র দেন। কবির পক্ষ থেকে সেই চিঠির জবাব দেন তাঁর একান্ত সচিব সুধীরচন্দ্র কর। ২০ জুলাই ১৯৩৯ তারিখে শান্তিনিকেতন থেকে লেখা পত্রে বসন্তকুমারকে জানানো হয়: "সবিনয় নিবেদন, কবি আপনার চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছেন। আপনাকে এই মহৎ কাজে সাহায্য করতে পারলে তিনি আরও সুখী হতেন সন্দেহ নাই।ফকির সাহেবকে তিনি জানতেন বটে, কিন্তু সে তো বহুদিন আগে; বুঝতেই পারেন, এখন সে সব সুদূর স্মৃতির বিষয় তাঁর মনে তেমন উজ্জ্বল নয়। তবে তিনি বললেন, কলকাতার লালবাংলা, ২০ নং মে ফেয়ার রোড, বালিগঞ্জ, এই ঠিকানায় সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর মশায় থাকেন। তিনিও ফকির সাহেবকে জানতেন। তাঁর কাছে খোঁজ করলে অনেক বিষয় আপনার জানবার সুবিধা হোতে পারে।”

রবীন্দ্রনাথ প্রথম লালনের গানের উল্লেখ করেন ১৯০৭ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর "গোরা" উপন্যাসে। আবখায়া-পরা একটি বাউল নিকটবর্তী দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইছে: "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, কমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মনোবেড়ী দিতেম পাখির পায়।"

তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে এই গান প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, "দেখিলাম, বাউলের গানও ঠিক ওই একই কথা বলিতেছে। মাঝে মাঝে বদ্ধ খাঁচার মধ্যে আসিয়া অচিন পাখি বন্ধনহীন অচেনার কথা বলিয়া যায়; মন তাহাকে চিরতরে ধরিয়া রাখিতে চায়, কিন্তু পারে না। এই অচিন পাখির যাওয়া-আসার খবর গানের সুর ছাড়া আর কে দিতে পারে?"

তথ্যসূত্র: আবুল আহসান চৌধুরী রচিত ও বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ "লালন শাহ"।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:২৬
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×