খবরঃ বাংলাদেশে নবনিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণকে চিকিৎসার জন্য ভারত গমনকারী বাংলাদেশি রোগীদের ভিসা পাওয়া সহজ করার ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন স্পিকার আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট।
আমার বক্তব্যঃ প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়া বাবদ কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে এমনকি আমাদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতানেত্রীরাও এখন সামান্য সমস্যা হলেই বিদেশে ছোটেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী এক বা একাধিক সঙ্গী সাথে নিয়ে যান। তাই শুধু যে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের হাতছাড়া হচ্ছে, সেটা না। এর সাথে যোগ করতে হবে রোগী ও তার সাথীর বিমানভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচ ইত্যাদি।
এই মুহুর্তে হাতের কাছে তেমন কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও এটা আন্দাজ করে নেয়া কঠিন হবে না যে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশগামীদের সিংহভাগই যান ভারতে। বাকিদে একটা বড় অংশ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ বা ব্যাঙ্ককের বামরুংগ্রাদ (উচ্চারণ ঠিক আছে?) হাসপাতালে। অতি দূরারোগ্য ধরনের রোগ না হলে খুব বেশি মানুষ ইউরোপ, আমেরিকার মত উন্নত দেশগুলোতে যান না। ছেলেমেয়ে বাইরের কোন দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলে অনেক বাবা-মাই ছেলেমেয়ের কাছে চলে যান চিকিৎসা করাতে, তবে এই শ্রেনীকে আমরা হিসেবের বাইরে রাখছি কারন এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসার চেয়ে সন্তানদের বাড়িতে বেড়াতে যাবার উপলক্ষ্যটাই বেশি থাকে।
লোকে সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ খরচ করে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে কেন যায়? সহজ উত্তর, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে তারা ভরসা করতে পারে না। এই ভরসা না করার পেছনে দুটো কারন থাকতে পারে - ১) হাসপাতালের দৈন্য দশা এবং ২) ডাক্তারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত সততা নিয়ে সন্দেহ। লক্ষ্য করুন, যে তিনটি দেশে (ভারত, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডে) মূলত বাংলাদেশের রোগীরা যাচ্ছেন, সেগুলোর কোনটাই খুব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী দেশ নয় বা তাদের পড়াশোনার মানও এমন কোন আকাশ-পাতাল উন্নত না। ভারত তো প্রায় বাংলাদেশের কাছাকাছিই। তাহলে কোন জাদুবলে চিকিৎসা সেবায় এই দেশগুলো এত উচ্চ মান অর্জন করতে পারল? আমি জানি না তারা কিভাবে পেরেছে, কিন্তু আমি এটা জানি যে আমরা কেন পারছি না।
আমাদের মত সীমিত সম্পদের দেশগুলো সম্পদ বিতরনে দু'ধরনের নীতি গ্রহন করতে পারে। হয় তারা পুরো সম্পদ সারা দেশের মানুষের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে পারে। অথবা বিশেষ উন্নত গোষ্ঠীকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে আরও উন্নত করতে পারে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যে বাজেট সেটা দেশের আনাচে-কানাচে সরকারী হাসপাতাল স্থাপন ও রক্ষনাবেক্ষন, প্রসূতি পরিচর্যা ইত্যাদি খাতেই শেষ হয়ে যায়। ফলে উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সত্যিকার অর্থে বিশ্বমানের একটা হাসপাতাল তৈরির প্রকল্প কখনোই নেয়া হয় না।
সরকারী মেডিক্যালগুলো ভর্তি প্রক্রিয়া যথেষ্ট কঠিন। পুরো ছাত্রজীবনে অত্যন্ত প্রতিভাধর এবং ভাল ফলাফল না হলে মেধাতালিকায় প্রথম দু'তিনশ জনের মধ্যে থাকা সম্ভব না। এই দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রচুর সময় এবং এনার্জি নষ্ট হয়ে যায় চাকরীজীবনের প্রথম কয়েক বছর প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারী হাসপাতালগুলোতে কাজ করতে গিয়ে। এসব প্রথম সারির ডাক্তারদের গ্রামেগঞ্জে না পাঠিয়ে বরং তাদের নিজেদের তৈরি করার আরও ভাল সুযোগ করে দিয়ে যথেষ্ট বড় বাজেট সহ মানসম্পন্ন অন্তত একটা হাসপাতাল তৈরি করা উচিৎ যেখানে এই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ডাক্তারেরা রোগীদের জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করবে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশের টাকা দেশেই রাখা যাবে, অন্যদিকে আশেপাশের স্বল্পোন্নত দেশ এমনকি ভারতের অনেক রাজ্য থেকেও রোগীকে নিয়ে আসা যাবে।
মাননীয় স্পিকার, ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে চিকিৎসা ভিসা সহজতর করার আবেদন আদতে প্রানঘাতী রোগের চিকিৎসায় ব্যাথানাশক ওষুধ ব্যবহারের মত। দয়া করে একটু দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের উদ্যোগ নিন। অন্তত একটা বিশ্বমানের হাসপাতাল তৈরি করুন যেখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ডাক্তারদের আচরন নিয়ে কোন অভিযোগ বা তাদের যোগ্যতা নিয়ে কোন সন্দেহ থাকবে না। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ডাক্তারদের সম্বন্ধে যে নেগেটিভ ইমেজ মানুষের মনে আছে, সেটা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে প্রতি ঘরে ঘরে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেও কোন লাভ হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১২ সকাল ১০:৪৫