somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ শীতের সকালে

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাঁটতে হাঁটতে অদূরে থাকা পার্কটার কাছে চলে এলো আবির। শীতের সকালে প্রায়ই সে একা একা হাঁটতে বের হয়। কুয়াশায় আচ্ছন্ন ভোরবেলা সবাই যখন লেপের ভিতর আরামসে ঘুমে মগ্ন তখন সে সুয়েটার, কেডস আর মাফলার গলায় পেঁচিয়ে রাস্তায় নেমে আসে।
রাস্তার পাশে টঙ চায়ের দোকান খোলা পেলে ওখানেই বসে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিতে থাকে। ঐ মুহুর্তের মতো এতো আনন্দ সে আর কখনো উপলব্ধি করতে পারে না। আনন্দের ঐ মুহুর্তের টানেই মনে হয় তার এই প্রায়শ বেড়িয়ে পড়া। শীতের শুরুতে সকাল বেলা উঠতে একটু কষ্ট হলে আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তার।

একটানা প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পর সম্মুখেই পার্কের ঢোকার প্রবেশ মুখ। পার্কের সবুজ ঘাসে ভোরের শিশির বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে আছে। শিশিরে ভেজা ঘাসগুলো চকচক করছিল যেন এই মাত্র স্নান করে ফিরলো তারা। খালি পায়ে শিশিরে ভেজা এই ঘাসের উপর হাঁটতে অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
পার্কের ভিতর মানুষের সমাগম খুবই কম। বিকেল বেলা তো জনসমুদ্র হয়ে যায়। কংক্রিট আর বিশাল বিল্ডিং-এ চারদিক ঢাকা এই শহরে পার্কের সবুজ ছায়ায় একটু শান্তির জন্য মানুষ এসে ভিড় করে। এখন যারাই আছে তারা কেউ কেউ জগিং করছে, আবার কেউ ব্যায়াম করছে। কেউবা সিমেন্টের বেঞ্চিটায় বসে খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছে; পাছে একটা বিড়িও ফুঁকিয়ে নিচ্ছে।

অনেকক্ষণ থেকে হাঁটার ফলে একটু ক্লান্তি লাগছিল আবিরের। পার্কের ভিতর ঢুকে একটা বেঞ্চির উপর বসলো। মাথাটা উপরের দিকে দিয়ে চোখের পাতাটা এক করে দিল একটু জিরিয়ে নিবে বলে।

ভাইজান ভাইজান ! হঠাৎ এই শব্দে আবিরের চেতন হল। এতক্ষন চোখটা বন্ধ করে প্রায় ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছিল সে। চোখ খুলেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ১১-১২ বছরের একটি ছেলে। কাঁধে তার ঝুলানো একটি বস্তা। পরনে শুধুমাত্র একটি ময়লা হাফপ্যান্ট। এতো ঠাণ্ডার মধ্যেও খালি গায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে এসবে সে অনেক অভ্যস্ত। চেহারা থেকে নিস্পাপের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে।

-ভাইজান,দুইটা টাকা দেন। ছেলেটা আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল।
-দুই টাকা দিয়ে কি করবে?
-আপনে দুই টেকা দিলে আমার কাছে আরও দুই টেকা আরও এক টেকা কারও কাছ থাইকা নিয়া বন (বাটার পাউরুটি)খামু।
-আপনার কাছে ৩ টেকা চাইলে তো আর দিবেন না তাই দুই টেকা চাইলাম। কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বলল ছেলেটা।
-আচ্ছা দিবো। তা তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না?
-আমাগো আবার কিসের ঠাণ্ডা? আমাগো লাইগা ঠাণ্ডা-গরম সবই সমান।
-নাম কি তোমার?
-আমার কিছু বন্ধু আছে তারা আমারে বইল্যা নামে ডাকে। আর আম পাবলিকে ডাকে “টোকাই” কয়া।
-তোমার বাবা -মা আছে ?
-না ভাইজান বাবা-মারে কোনদিন দেখিই নাই। বুঝ হওয়ার পর থাইকা বস্তির আজম চাচার কাছে বড় হইছি। আজম চাচায়ও মারা গেল দুই বছর হইয়া গেছে। এরপর থাইকা রাস্তায় রাস্তায়। কোনসময় রাস্তায় আবার কোন সময় পার্কে শুইয়া রাইত পার কইরা দেই। যেখানে রাইত সেইখানে কাইত হইয়া যাই। তাও পুলিশে মাঝে মইদ্ধে বিরক্ত করলে ঐ রাইত আর ঘুমই অয় না।

কথা শুনে কেমন যেন মায়া লাগলো ছেলেটার প্রতি। আবিরেরও ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছোট একটা ভাই আছে। ওর মুখটার কথা কেন জানি ভেসে উঠলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার মুখে।

- খিদা লাগছে তোমার? জিজ্ঞেস করলো আবির।
- খিদা তো ভাইজান অলটাইমই থাকে। খিদা লাগছে দেইখা তো আপনের কাছে দুই টেকা খুঁজলাম।
-বাহ ইংরেজিও জানো দেখছ। পড়ালেখা করো?
-হাসল বইল্যা। না ভাইজান পড়ালেখা করি না। আপনারদের মতো কিছু শিক্ষিত মানুষের কথা শুইনা শুইনা শিইখা ফালাইচি।
-খিদা আমারও লাগছে। চলো ঐ দিকে একটা রেস্টুরেন্টে আছে ঐখানে যাই।
বইল্যা সন্দেহের চাহনি নিয়ে বলল, ভাইজান আপনি ছেলেধরা-টেলেধরা না তো ?
আবির হাসলো। আরে না আমি এসব কিছু না। তোমার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লেগেছে। তাছাড়া তোমার সাথে সাথে আমিও ক্ষুধার্ত তাই বললাম আর কি। এখন তুমি চাইলে আসতে পারো, তোমার ইচ্ছা।
হুম তাইলে চলেন। তাছাড়া আপনেরে দেখে এই সব মনেও হয় না।

রেস্টুরেন্টে এসে ওয়েটারকে ডাক দিয়ে নাস্তার অর্ডার দিল আবির। ওয়েটারটা যাবার সময় বাঁকা চোখে চেয়ে গেলো বইল্যার দিকে।

-তা বইল্যা। রাতে তো প্রচণ্ড শীত থাকে ঘুমাও কিভাবে?
বইল্যা কোন কথা না বলে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ব্লেড বের করে টেবিলের উপর রেখে বসল।
-এই যে ব্লেড দেখতাসেন ভাইজান এইটা দিয়া ব্যানার কাটি।
-ব্যানার কাটো মানে ? অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো আবির।
-রাতে বেশি ঠাডা পড়া শীত পড়ে। আর সামনে তো আরও বেশি শীত পরবো। তাই ব্যানার কাইটা শরিলে জড়াইয়া ঘুমাইলে ঠাণ্ডা একটু কমই লাগবো।

কথাগুলো শুনে এতোটাই খারাপ লাগলো আবিরের যে নিজের অজান্তেই মনের কোণ থেকে কখন একবিন্দু অশ্রু জড়িয়ে পরলো সে তা টেরই পেল না। এত কম বয়সে এই সব ছেলেরা এতো অবহেলিত? এতো কষ্টে দিন যাপন করে এরা ? আমরা কি কিছুই করতে পারি না এদের জন্য ? মানুষ হিসেবে দাম দিলে কোন মানুষের জন্য কিছু করতে মন চায়। কিন্তু আমরা তো এদের মানুষই মনে করি না। কাছে এসে এক টাকা দুই টাকা খুঁজলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেই, সাথে দেই কয়েকটা গালি। কবে যে এদের এই দুঃখের দিন শেষ হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন।

এরই মধ্যে ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। খাবার দেখে বইল্যার চোখেমুখে খুশির ছটা ফুটে উঠলো।
-ভাইজান, এইসব খাবার এর আগে অনেক দেখছি কিন্তু কখনো খাওয়া হয় নাই।
-তাহলে এবার যত খুশি খাও।

খুব তাড়াতাড়িই খাওয়া শেষ হয়ে গেল দুজনের। ঢেকুর তুলতে তুলতে বইল্যা বলল, ভাইজান আজকে আর খাওয়া লাগব না। যে খাওয়া খাইছি তাতে আইজ পার হইয়া যাইব। আপনারে অনেক ধইন্যবাদ ভাইজান। এরকম করে কেউ কোনদিন খাওয়ায় নাই।

-আরে ধন্যবাদ কিসের?
-তোমাকে খাওয়াতে পেরে অনেক ভালো লাগছে আমার।
- ভাইজান এবার আমাকে যেতে হবে না হলে সিটি কর্পোর গাড়ি সব ময়লা নিয়া গেলে শেষে কিছুই পামু না আমি। বইল্যা যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো।

একটু দাঁড়াও বইল্যা। আবির তার পড়নের সুয়েটারটা খুলে বইল্যাকে দিয়ে বলল, এটা রাখ তুমি। তোমার শীত কিছুটা হলেও কম লাগবে হয়তোবা রাতে আরামে ঘুমাতেও পারবে।
বইল্যা খুব বেশি অবাক হল।
-ভাইজান,আপনার তো এখন ঠাণ্ডা লাগবো।
-আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি বাসায় চলে যাব একটু পরে। তখন আরেকটা পড়ে নিবো। এটা তুমিই রাখো।
-ভাইজান,আমি আপনার মতো ভালো মানুষ এই দুনিয়াতে আরেকটা দেখি নাই। দুনিয়াতে আপনি অনেক বড় হবেন। চোখ দুটি ছল ছল হয়ে উঠলো বইল্যার।
-লজ্জা দিও না আমাকে বইল্যা। ভালো থেকো।
-না ভাইজান আপনে হাছাই খুব ভালা মানুষ। আপনেও ভালো থাকেন ভাইজান।

চোখ মুছতে মুছতে বইল্যা রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেল। সুয়েটারটা এক হাতে আর আরেক হাতে বস্তাটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেল পার্কের সবুজের মধ্যে। আবিরও উঠতে যাবে এমন সময় দেখে বইল্যার ব্লেডটা টেবিলের উপর পড়ে আছে।
আবির ব্লেডটা হাতে নিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল-ব্লেডটার কি আর দরকার আছে ?

*******************************************************************
সামুতে ব্লগিং শুরুর দিকে লেখাটি পোস্ট করেছিলাম। কোন এক কারণে লেখাটি ড্রাফট করতে গিয়ে ভুলবশত মুছে যায় তাই নতুন করে পোস্ট দিলাম যাতে ভার্চুয়াল ভাবে লেখাটা সেভ হয়ে থাকে B-)

********************************************************************
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:০১
৩৪টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×