গাছের আগায় পানি না ঢেলে গোড়ায় পানি ঢালার কথাটা আমরা মুখে বললেও কাজে খুব একটা মানি না। উপদেশ সবাই দিতে পারেন, দিতে পছন্দ করেন, উপদেশ দিয়ে দিয়ে সব উল্ডাইয়া হালান, কিন্তু উপদেশ শোনার ক্ষেত্রে সকলেরই বিরক্তিকর মানসিকতা একটু একটু উপচে পড়ে। নিতান্তই গুরুজন না হলে উপচানোর ক্ষেত্রটা হাড়ি থেকে চুলোয় যায় এবং তরকারী বা ভাতের বদলে অগ্নিকান্ডস্বরুপ, উপদেশের বদলে শ্রোতার পক্ষ থেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য অথবা বন্ধুস্থানীয় হলে গালাগালির তুবড়ি ফোটে। তাই গাছের গোড়ায় পানি দেবার কথা সকলে জানেন এবং বলেন কিন্তু মানেন না।
আমরা আমাদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ অথবা উপজেলা চেয়ারম্যান এদের কুকীর্তির জন্য বস্তায় বস্তায় সমালোচনা, কটুকথা, খিস্তি খেউর এবং মৃত্যুকামনা বরাদ্দ রাখি। পরিস্থিতি আপনাকে সেই অধিকার দেয়ও। কিন্তু আমরা উপরের দিকে তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আলোকিত চেহারা, মাঝের দিকে নিজের শরীরের দুর্ভিক্ষপীড়িত পাজরের হাড় গুনতে গুনতে ভুলে যাই যে নীচের মাটির দিকেও তাকানো দরকার। কারণ শস্য উতপাদন নীচের মাটিতেই হয় এবং আমাদের জীবন্ত কঙ্গাল ও প্রধানমন্ত্রীর হৃষ্টপুষ্ট শরীর বেচে থাকে ঐ মাটির শস্যদানায়।
একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে নির্বাচনি প্রচারনায় কি পরিমান ব্যায় করেন তা আমরা ভালভাবেই অবগত। যথাযথ ব্যায় না হলে নির্বাচন করাটা কঠিন তো বটেই এমনকি অসম্ভবও বটে। তা এই বিশাল নির্বাচনী ব্যায় কি মাননীয় সংসদ সদস্য তার বাপের বাড়ীর ধান বিক্রি করে নির্বাহ করবেন? কোটি কোটি টাকা কি একটেলের ঐ খিস্তি থেকে আসে? কার এমন ঠেকা পড়েছে যে এত কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে দেশের সেবা করবেন? সংসদ সদস্য হিসেবে তার দেশসেবা করার কথা, কিন্তু এত কষ্ট করে যে উনি দেশসেবা করবেন, এত টাকা ব্যায় করে জনগণের জন্য নির্বাচনে দাড়াবেন, উনার এই টাকাগুলো কি আমরা দেব? কেউ কেউ এখন তার ব্যাক্তিগত অবদানের কথা বলতে পারেন, তবে তাদের আমরা গণনায় ধরব না, কারন উদাহরণ হতে হবে সার্বিক।
এই কোটি টাকা উসুল করতে যেয়ে শুরু হবে দুর্নীতি, চাদাবাজি। স্বেচ্ছায় যখন দিতে চাইবেন না তখন জুলুম হবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি তার হিসাবে গড়মিল হতে দিবে না কখনই।
কারও এত ঠেকা পড়ে নাই যে সেধে সেধে ঘরের গোলা থেকে এনে এনে দেশসেবা করে যাবে। দুই একজনের কথা বাদ দিন। ওটা নিয়ে অন্য কোথাও রাজনৈতিক তেলবাজী করুন এবং দলীয় সম্মান বৃদ্ধির জন্য জান প্রাণ দিয়ে খাটাখাটনি করুন।
দুঃখজনক হলেও সত্য এই খাটাখাটনি করা লোকগুলো যাদের আমরা তেলবাজ হিসেবে ঘৃণা করি এরা আমাদের সাধারণ ভদ্রলোক থেকে উত্তম। এদের সক্রিয় অংশগ্রহণই আমাদের এই খারাপভাবে বাচিয়ে রেখেছে, নতুবা আমাদের মরতে হত।
........................
ক ও খ একই স্কুলের ছাত্র ছিল। ক ছিল প্রথম সারির আর খ কোন সারিরই ছিল না। ক এর অর্থিক অবস্থা ভাল নয় এবং খ এর পিতা একজন ধনী মানুষ। যথাসময়ে ক ও খ বড় হল, দাড়ি গোঁফ গজাল। বিগত নির্বাচনে স্থানীয় আসনে একটি দলের প্রতিনিধি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল। ক এর পিতা যেহেতু ধনী এবং নব্য ধনী, সেহেতু তার আরও বেশী ধনী হওয়া প্রয়োজন। ভদ্রলোকদের মত সে নির্লিপ্ত নয়। তাই সে প্রতিনিধিকে ব্যাপক সহযোগীতা করল এবং শেষ পর্যন্ত সংসদে পাঠিয়ে ছাড়ল। ক ও খ কিছুদিন হল উক্ত প্রতিনিধির স্থানীয় ছাত্র সংগঠনের শাখায় যোগদান করেছে। ক এর মনে দেশপ্রেম খেলা করে আর খ এর মনে ক্ষমতার স্বাদ এবং ভবিষ্যত সম্পদ বৃদ্ধি উকি দেয়। স্থানীয় ছাত্র সংগঠনটির কমিটি গঠনের দিন ঘনিয়ে আসছে। ক তার মেধা আর প্রাণশক্তি দিয়ে যতটুকু পারছে দলকে সাহায্য করছে আর খ যতটুকু পারছে ক কে ব্যাবহার করছে। খ এর আশেপাশে অনেকেই আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। খ এর আশেপাশে যারা আছে তাদের মাথায় চিন্তা ভবিষ্যতে বিশাল ভবনের একটুকু রং যদি গায়ে লাগে তাই বা ক্ষতি কি, বিনামূল্যে একটু রংয়ের মালিক হওয়া যাবে। ক এর আশেপাশে কেউ নাই। কারণ ক এর কাছে ভবিষ্যতে বিশাল ভবন নাই। ক অবিবেচকের মত দলের জন্য খাটে। ক তার আশেপাশের ভদ্রলোক বন্ধুদের ডাকে। কারণ যেহেতু ক এর অর্থ নাই, সেহেতু যদি একটু লোকসমাগম করে নিজের অবস্থানটা ঠিক করা যায়। অবস্থানের প্রতি ক এর লোভ নাই, অবস্থানটা ক এর প্রয়োজন। মালিক না হলে আপনি যতই ব্যাবসাবুদ্ধি জানুন না কেন আপনি আপনার প্রতিষ্ঠান দাড় করাতে পারবেন না। তাই স্থানীয় কমিটির সভাপতি হওয়াটা ক এর বড় দরকার। সে একা একা দৌড়ায়। এখান থেকে ওখানে, এই ছাত্রনেতা থেকে ঐ ছাত্রনেতার কাছে, এই নেতার থেকে ঐ নেতার কাছে। তাকে একটু সাহায্য করারও কেউ নাই, সাপোর্ট দেবার কেউ নাই। ক এর ভদ্রলোক বন্ধুরা ইতিমধ্যে ক কে বারংবার নিরুতসাহিত এবং শেষতক কটুক্তি পর্যন্ত করেছে এসব রাজনীতির ব্যাপারে না জড়ানোর জন্য। কারণ তাদের মত ক কিছুতেই খ এর সাথে পারবে না। খ এর মত টাকা ক এর নাই। ক এর পরাজয় সুনিশ্চিত। তাই এই নিশ্চিত ব্যার্থতা থেকে ক এর ভালয় ভালয় সরে আসা উচিত। যে কাজে ফল নাই সে কাজ করার কোন মানে হয় না, ইত্যকার নানা উপদেশ ক এর উপর বর্ষিত হতে থাকে প্রতিনিয়ত। ক ভেঙ্গে পড়তে চায়। কিন্তু তারপরও সে ভেঙ্গে পড়ে না। সংসপ্তক বোধহয় একেই বলে। ক দৌড়ায়। এ দ্বার থেকে ও দ্বারে দৌড়ায়। রুচিশীল, ভদ্রলোক অভিবাবকরা ক কে তিরষ্কার করে। তার বোকামী নিয়ে উপদেশ দেয়। ক তবুও দৌড়ায়। যদি পারা যায়! ক এর এককালীন শিক্ষক যিনি বর্তমানে ক এর মূল দলের একজন পাতিনেতা উনি ক কে ফোনে দৌড়াতে নিষেধ করেন। কারণ তারও একজন পছন্দের প্রার্থী আছে। এবং সে হল খ। উক্ত শিক্ষক খুব ভাল করেই জানেন গাণিতিক হিসাব নিকাশ ক, খ এর থেকে ভাল পারে। উক্ত শিক্ষক ক,খ উভয়েরই গণিতের শিক্ষক ছিলেন। উক্তি শিক্ষরের বিষয়ে ক প্রথম সারির নম্বর পেত এবং খ অকৃতকার্য হত। তবু উক্ত শিক্ষক এই কাজটি করলেন। ক এতে খুব দুঃখ পেয়েছিল। যে শিক্ষকের সাথে শ্রেণীকক্ষে সে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক গণিতালাপ করত, যে শিক্ষক তার মস্তিষ্কের প্রশংসা করত সে শিক্ষক আজ কিভাবে তাকে নিরুতসাহিত করে। এই কি সেই শিক্ষক যে তাকে স্বপ্ন দেখাত। আসলে সব ছিল মিথ্যা। গণিত মিথ্যা ছিল, মিথ্যা ছিল স্বপ্ন দেখানো, মিথ্যা ছিল ঐসব ভাল উপদেশ। অল্পবয়সীদের আসলে উপদেশ দেবার অথবা নীতি শেখাবার কোন অধিকার বেশীবয়সীদের নাই। কারণ চিনি খাওয়া বন্ধ করতে বলার আগে নিজের চিনি খাওয়া বন্ধ করা উচিত। ক শুধু এতটুকুই বলল, "স্যার ও আপনার ছাত্র ছিল, আমি কি আপনার ছাত্র ছিলাম না।" শিক্ষক চুপ করে গেলেন। কারণ ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ক এর সাথেই তার বেশী ছিল শ্রেণীকক্ষে।
ক দৌড়ায়। এ দ্বার থেকে ও দ্বারে। আমরা কেউ তাকে সাহায্য করি না। বিন্দুমাত্র উতসাহও সে কারো কাছ থেকে পায় না। তবুও সে একা একা নিজেকে উপরের দিকে পরিচিত করে তোলে। সভাপতির পদটা তার দরকার। হয়তো অবাক হবেন জেনে, এই সামান্য স্থানীয় সভাপতির পদটা যদি আপনার দখলে থাকে আপনি অনায়াসে কোটি খানেক টাকার মালিক হতে পারবেন। ক এই কোটিখানেক টাকার অযথা ব্যায় কমাতে চায়। সে দৌড়ায় একা একা। ক একটা পরিবর্তন চায়। কিন্তু ভেজালের বাজারে কে আর আসল জিনিস চাখে মশাই। কারও পেটে এখন আর আসল জিনিস সহ্য হয় না। আসল জিনিস উতপাদন বন্ধ করা দরকার। দরকার ক কে থামানো।
ক প্রায় সফলতার কাছে পৌছায়। কিন্তু স্থানীয় সংসদ প্রতিনিধি খ এর বাবার সাথে সম্পর্কের জের ধরে খ কেই মনোনিত করে।
ক জানত এটা হবে। রুচিশীল, ভবিষ্যতবেত্তা, ভদ্রলোক সমাজও জানত। তবুও ক তার দৌড় থামায়নি। উল্টো এই সুশীল সমাজ ক এর শার্টের পেছনে টেনে ধরেছে। অনেকটা বলা যায়,"আহা খোকা শুধু শুধু দৌড়ে কেন হাপাবে, দৌড়ে তোমার পরাজয় নিশ্চিত, তুমি দৌড় থামাও।" ক তবুও দৌড় থামায়নি। কারণ ক জানত কাউকে না কাউকে দৌড় প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করতে হবে। হয়তো তাকে দিয়েই শুরু। সে ব্যার্থ হবে, তার পরেরজনও হবে, তার পরেরজনও হবে, কিন্তু একবার যদি সফলতার সূচনা করার যায় তবেই কিছু একটা করা সম্ভব। ক তাই রাজনীতির কাদামাটি নোংরা তার গায়ে মাখিয়ে কেলে ভূত সেজে উপহাসিত হয়েছে সেচ্ছায়। তার মনে এটা নিয়ে কোন ক্ষেদ নেই। উল্লেখ্য ক সভাপতি হতে না পারলেও সেক্রেটারী হতে পেরেছে। ক এবং খ এর মধ্যে খুব শীঘ্রই সংঘর্ষ হবে মারাত্মকভাবে। আমরা যদি ক এর পাশে না দাড়াই তবে তা হবে আমাদের নিজেদের বুকে নিজেরাই ছুরি মারার মত। বাংলাদেশ এভাবেই নষ্ট হয় এবং তা আমাদের এই অসহযোগীতার কারনেই। আমরাই এর জন্য দায়ী। আমাদের নির্লিপ্ততাই খ দের স্থান করে দেয়, তাদের উপরে উঠার সিড়ি মজবুত করে। আপনারা দয়া করে সহযোগীতা করুন। ক দের বাচতে দিন। সামান্য বহুতল ভবনের রংয়ের ঘষা খাওয়ার জন্য আত্মহত্যা করবেন না।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



