তুমি যদি রজনীগন্ধা ফুল হতে, তবে তোমাকে আমি রেখে দিতাম-
আমার জানালার পাশে।
সারারাত তুমি গন্ধ ছড়াতে ...আমি ঘুমিয়ে পড়তাম-
তবু তুমি গন্ধ ছড়াতে !
সকাল আটটা।
বাসা থেকে নাস্তা করে আয়রন করা জামা কাপড় পড়ে বের হয়েছি। যাবো উত্তরা। মনে মনে ভাবছি, নিজের জন্য যারা পড়াশোনা করেন তারা সম্মানিত কিন্তু চাকরির জন্য যারা পড়তে চায় তারা দেশের মেরুদন্ডটাকেই নড়বড়ে করে দেয়। বড় রাস্তার মুখে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় দেখি একজন অল্প বয়সী মা তার ছয় মাসের বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বুঝেছি মা এবং কোলের শিশুটি প্রচন্ড অসহায়। মায়ের চোখে প্রচন্ড দিশেহারা ভাব। মায়ের সাথে কথা বললাম। তাদের থাকার জায়গা নেই। ফুটপাতে ঘুমায়। বাচ্চাটির নাম মানিক। মানিকের বাপ মারা গেছে মানিক পেটে থাকতেই। এখন এই মা তার শিশু সন্তানকে নিয়ে ফুটপাতে থাকে। এই অল্প বয়সী মা ভিক্ষা করার নিয়ম কানুনও কিছুই জানে না। সারা দিনে সে মানিককে কোলে নিয়ে এক শ" টাকাও ইনকাম করতে পারে না। খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে। আমি মানিককে কোলে নিলাম। মানিক বেশ আগ্রহ নিয়েই আমার কোলে এলো। আমি বেশ কয়েকবার মানিক-মানিক বলে ডাকলাম। বাচ্চাটা জানে তার নাম মানিক। আমি যতবার মানিক-মানিক বলেছি বাচ্চাটা হেসে দিয়েছে।
ছবিতে মানিক ও তার মা।
কেউ কি বলতে পারবেন এই ঢাকা শহরে মানিক ও তার মায়ের মতো কত জন আছে? অথবা সমস্ত বাংলাদেশে কত মানিক ও তার মা আছেন? এই দেশের সমস্ত মানিক আর মানিকদের মা'দের গল্প প্রায় একই রকম। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। পেটে বাচ্চা এসে গেছে, স্বামী পালিয়ে গেছে, অথবা ছেড়ে চলে গেছে। থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তারা জানেই না দেশে সরকার আছে। এবং তাদের সহযোগিতা করার জন্য মন্ত্রনালয় পর্যন্ত আছে। সমস্ত দেশে ধরে নিচ্ছি এরকম মানুষের সংখ্যা তিন লাখ। এই তিন লাখ মানূষের দ্বায়িত্ব কে নিবে? অবশ্যই সরকার। আচ্ছা, সরকার এদের জন্য কি কি করেছে? আমাদের দেশে 'মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়' (Ministry of Women and Children Affairs) আছে। এরা সম্ভবত দরিদ্র মহিলা ও শিশুদের জন্য কাজ করে থাকে। আমি আজ মানিকের মা-কে বললাম মগবাজার-ইস্কাটনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে গেলে সে সরকারের পক্ষ থেকে উপকার পাবে, সাহায্য পাবে। কিন্তু মানিকের মা আমার কথা সম্ভবত বিশ্বাস করেনি।
আমি নিজেই গেলাম মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। সেখানে দেখলাম তারা বিশাল গেট করেছে। ডিজিটাল সাইন বোর্ড করেছে। তাদের উন্নয়নের কর্মকান্ড লিখে রেখেছে। (পোষ্টের শুরুতেই উপরের ছবিটা লক্ষ করুন) তারা কি কি কাজ করেছে সব লেখা আছে। বেশ কিছু ছবিও আছে। তারা যদি সত্যি সত্যিই নারী ও শিশুদের জন্য এত-এত কাজ করে থাকে তাহলে রাস্তায় রাস্তায় যারা সারাদিন ঘুরে বেড়ায় আর ভিক্ষা করে তারা কারা? অন্যান্য সরকারী অফিস যেরকম, এটাও সেরকম। কেউ কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারে না। আমি ওদের কথা মতো এক টেবিল থেকে আরেক টেবিল ঘুরতে থাকলাম। এই টেবিলে গেলে, সে আরেক টেবিলে পাঠায়। আরেক টেবিলে গেলে সে আরেক টেবিলে পাঠায়। কোনো কোনো টেবিল খালি। ছুটিতে আছে। একজন আমাকে ডেকে বলল- কি মিয়া ভাই মেলার জন্য স্টল দিতে চান? আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
পৃথিবীতে তথা আমাদের দেশে কে কেমনভাবে বেঁচে আছে তা নিয়ে বহুকাল আমি সত্যিকারের মাথা ঘামাইনি। দুঃখ-দুর্দশায় নাভিশ্বাস ওঠা এই দেশে যে আমি নিজে সপরিবারে খেয়ে এবং মোটামোটি সুখেই থাকতে পারব এটা বুঝেই এতদিন তৃপ্ত ছিলাম। মাঝে মাঝে দরিদ্র মানুষকে সাহায্য দেওয়া, সমবেদনা বোধ করা এবং মানুষের জন্য কিছু করা উচিত বলে ভাবা, এছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার। সকালে বাস স্ট্যান্ডে অনেকক্ষন আজ দেশের মানুষজন নিয়ে ভাবলাম। বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপ-চাপ কষ্ট হলো। মরেই যদি যাই- তাহলে পৃথিবীর আরও কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হোক। সারা পৃথিবীতে হাতে গোনা অল্প কিছু মানুষের সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছে, অথচ পৃথিবীতে কত কোটি কোটি মানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৫২