মুজিবুল হক একটা বাইয়িং হাউজের পিয়ন।
সে মানুষকে বলে- office assistant। এই বায়িং হাউজে আরও দুইজন পিয়ন আছে। তারা বিরাট ফাঁকিবাজ। লেখাপড়া কতটুকু করেছে কে জানে! আর মুজিবুল হক ইন্টার পাশ। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়া। অতি মিষ্ট ব্যবহার। অফিসের প্রায় সবাই তাকে পছন্দ করে এটা ভাবার কোনো কারন নেই। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে অফিস শুরু। আর শেষ হয় বিকেল সাড়ে পাঁচ টায়। এই আট ঘণ্টা অফিসে মুজিবুল হক তুফানের মতো কাজ করে যায়। দশ মিনিট অবসর পায় না। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময়টুকুও পায় না। কেউ পানি চায়। কেউ চা চায়। কেউ ফোটো কপি করতে বলে। কেউ শিঙারা আনতে বলে। কেউ ফাইল আনতে বলে। এবং সবাই আর্জেন্ট। দেরী করলেই সমস্যা। নানান জন নানান কটু কথা বলে।
মুজিবুল হক থাকে কমলাপুর। ভাড়া বাসা।
তার অফিস উত্তরা। কমলাপুর থেকে উত্তরা যেতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। মুজিবুল হক বিয়ে করেছে। তার একটা চার বছর বয়সী এক ছেলে আছে। ছেলের নাম রুমন। রুমন ইদানিং খুব দুষ্ট করে। আগামী বছর তাকে স্কুলে ভর্তি করা হবে। রুমনের মা ক্যান্সারে রোগো তিন বছর ভূগে মারা যায়। রুমন এখন তার খালার কাছে থাকে। মুজিবুল হক তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। এত'ই ভালোবাসতেন যে তার আত্মীয় স্বজনরা অনেকবার বলার পরও তিনি বিয়ে করতে রাজী হননি। সারাদিন অফিস শেষ করে উত্তরা থেকে মুজিবুল হকের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয় টা, দশটা বেজে যায়। বাসায় ফিরে দেখে ছেলে গভীর ঘুমে। ঘুমন্ত ছেলের কপালে চুমু খায়।
মুজিবুল হক আর আমি একই কলেজে লেখাপড়া করেছি।
দেখতে বেশ স্মার্ট। উঁচা লম্বা। স্বাস্থ্য ভালো। কথাও বলে খুব সুন্দর করে। সেদিন দুপুরে আমি বনানী প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির সামনের ফুটপাতে সিঙ্গারা আর চা খাচ্ছিলাম। হঠাত দেখি এক লোক আমাকে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরলো। যে আমাকে জড়িয়ে ধরলো তাকে আমি একেবারেই চিনতে পারলাম না। হা করে তাকিয়ে থাকলাম। লোকটি বলল, বন্ধু আমাকে চিনতে পারো নি? আমি লম্বু মুজিবুল হক। নাম বলার পরও আমি চিনতে পারিনি। তারপর মুজিবুল হক একে একে পুরোনো দিনের বেশ কিছু সৃতি বলল। এবং আমার সব মনে পড়লো। প্রায় ১৬/১৭ বছর পর দেখা কলেজ জীবনের বন্ধুর সাথে। একবার আমরা লঞ্চে করে শরীয়তপুর গিয়েছিলাম। আমি লঞ্চ থেকে নামতে গিয়ে নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম। এই মুজিবুল সাথে সাথে লাফ দিয়েছিল নদীতে আমাকে বাচানোর জন্য।
আমি জানতাম, মুজিবুল হক সৌদি চলে গেছে।
তারপর আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই। এই এত বছর পর আজ দেখা। মুজিবুল হক বলল, সৌদি গিয়ে তিন মাস পর সে দেশে ফিরে এসেছে। এত গরম তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। তাছাড়া তারা তাকে অফিসের কাজ দিবে বলে নিয়ে গেছে, অথচ তাকে কাজ দিয়েছে হাসপাতালের বয় হিসেবে। তাই দেশে ফিরে এসেছে। সে এখন বাপ মায়ের সাথে থাকে না। তার ভাইয়েরা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কারন মুজিবুল তাদের অমতে এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে। এক দূরসম্পর্কের বোনের সাথে থাকে এখন। থাকা খাওয়া বাবদ বোনকে দশ হাজার টাকা দেয় প্রতিমাসে। অফিস আর সন্তান এই নিয়েই মুজিবুল হকের বর্তমান জীবন।
মুজিবুল বলল, দোস্ত তোর কথা বল।
আমি বললাম, বিয়ে করেছি। ছয় বছর বয়সী এক মেয়ে আছে। সে স্কুলে পড়ে। মোবাইলে মেয়ের ছবি দেখালাম। আমি বর্তমানে বেকার অবস্থায় আছি বলা যায়। আমি বেকার আছি শুনে, মুজিবুল যেন খুব কষ্ট পেল। বলল, দোস্ত তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমি আমার অফিসে তোর জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করবো। দরকার হলে এমডি'র পায়ে গিয়ে ধরবো। আমি বললাম, পায়ে ধরতে হবে না। মাস শেষে আমার তো বাড়ি ভাড়া দেওয়ার চিন্তা নেই। খেয়ে পড়ে বেঁচে তো আছি। যাই হোক, রাস্তায় দাঁড়িয়েই আমরা প্রায় এক ঘন্টা অতীতের ঘটনা নিয়ে খুব আলাপ করলাম। মোবাইল নম্বর নিলাম। দিলাম। আমাদের আবার দেখা হবে শবে বরাতের রাতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:৩৮