মকবুল একজন কবি।
সম্প্রতি তিনি হজ্ব করেছেন। এখন তিনি নামের শুরুতে ‘আলহাজ্ব’ বসিয়েছেন। আলহাজ্ব মকবুল। মকবুল সাহেব এলজিইডি’তে চাকরী করেন। সরকারী চাকরী অনেক সুযোগ সুবিধা। অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গত বিশ বছরে মকবুল প্রায় আড়াই হাজার কবিতা লিখেছেন। নিজে টাকা দিয়ে এগারোটা কবিতার বই ছাপিয়েছেন। প্রতিটা বই’ই বইমেলা বের করেছেন। বাংলাদেশে কবিতার বই বিক্রি হয় না। কাজেই বইমেলাতে তার বইও বিক্রি হয়নি। তবে তার প্রকাশকরা খুশি। মকবুল সাহেব তার বইয়ের প্রকাশকদের খরচের ডবল টাকা দিতে কার্পন্য করেন না। আগামী বইমেলাতেও মকবুল সাহেবের কবিতার বই বের হবে। এই বইটি নিয়ে তিনি আশাবাদী। বইটির নাম রেখেছেন, ‘আকাশ কেন কাঁদে’। প্রচ্ছদ করিয়েছেন, ধ্রুব এষকে দিয়ে।
বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে টাকা দিয়ে মকবুল সাহেব নিজের সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছেন। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি তার ছোটবেলার একটা ঘটনা প্রায়’ই বলেন। ঘটনাটি এই রকম- ‘ছোটবেলা তিনি ঘুড়ি উড়াতে খুব পছন্দ করতেন। অথচ তার বাবা তাকে ঘুড়ি ও নাটাই কিনে দেন না। একদিন তার বাবা তাকে বাজারে পাঠান। মকবুল বাজার করতে গিয়ে পঁচিশ টাকা চুরী করেন। সেই চুরীর টাকা দিয়ে ঘুড়ি ও নাটাই কিনেন। অনেক সময় নিয়ে সূতায় মাঞ্জা দেন। বাড়ির ছাদে ঘুড়ি উড়ানো শুরু করেন। এবং পাশের বাড়ির ছাদে রফিক সাহেবের ছেলে তন্ময় তার ঘুড়ি কেটে দেয়। মকবুল পড়ে গেলে বিপদে। সবাই ঘুড়ি উড়াচ্ছে। অথচ তার ঘুড়ি নেই। ঘুড়ি যে কিনবে তার কাছে টাকাও নেই। নাটাই আর সূতা কিনে চুরী করা পঁচিশ টাকা শেষ। তার ভাগ্য ভালো এমন সময় একটা ঘুড়ি কাটা পরে। মকবুল সেই ঘুড়ির পেছনে দৌড় দেয়। ঘুড়িটা একটা আম গাছের ডালে বেঁধে যায়। মকবুল সেই ঘুড়ি ধরতে গিয়ে একটা টিনের চালে উঠে। এবং সেই টিনের চাল থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভাঙ্গে।
উঠতি কবিদের সঙ্গে আড্ডায় চা নাস্তার বিল সব সময়ই মকবুল সাহেব দেন। মাঝে মাঝে তথকথিত কবি সাহ্যিতিকদের মদ খাওয়াতে হয়। এখন মদ খাওয়ানোটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি সপ্তাহে একবার। মকবুল সাহেব একা মানুষ। বিয়ে করেন নি। যৌবনে এক মেয়েকে ভালোবাসতেন। মেয়েটির নাম শাহানা। কিন্তু শাহানা তাকে বিয়ে না করে অন্য একজনকে বিয়ে করে এখন আমেরিকা বসবাস করছে। মকবুল সাহেবের ইচ্ছা আছে চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর আমেরিকা গিয়ে শাহানাকে জিজ্ঞেস করবেন, কেন তাকে বিয়ে করেনি। হয়তো শাহানার সাথে বিয়ে হলে জীবনটা অন্যরকম হতো। শাহানা কোথায় আছে, কি করছে- সব খোঁজ খবর’ই তার কাছে আছে। শাহানা দারুন সুন্দরী ছিল। সবচেয়ে সুন্দর ছিল তার চোখ।
এক সাহিত্য আড্ডায় একজন তথাকথিত কথাসাহ্যিতিক মকবুল সাহেবকে বললেন, বাংলাদেশে কবিতার ভাত নেই। এই দেশের বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র। দরিদ্র মানুষেরা কবিতা পড়ে না। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ ছাড়া পাঠক আর কারো কবিতা আগ্রহ নিয়ে পড়ে না। কবিতা লেখা বাদ দেন। গল্প উপন্যাস লেখা শুরু করুন। এই দেশে এখনও কিছুটা গল্প উপন্যাসের চাহিদা আছে। সহজ সরল সত্য কথা হলো- মকবুল ভাই, আপনার কবিতা মানহীণ। ভাষা সুন্দর না। ছন্দ-মাত্রা কিছুই ঠিক না। ভাব নেই, আবেগ নেই। বড্ড এলোমেলো, বড্ড অগোছালো। যারা আপনার কবিতা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখায়, তারা মিথ্যা উচ্ছায় দেখায়। আপনার কাছ থেকে চা-নাস্তা আর মদ খাওয়ার জন্য তারা আপনাকে মিথ্যা বাহবা দেয়। আর কতদিন বোকা থাকবেন? এবার একটু চালাক হন। প্লীজ। সত্য কথা বলতে কি- বিশেষ একজন মানূষের স্বচ্ছ পবিত্র ভালোবাসা না পেলে জীবনে কবিতা লেখা যায় না। আপনি জীবনে কোনো নারীর স্বচ্ছ পবিত্র প্রেম ভালোবাসা পান নি। আপনি ব্যর্থ।
রাতে বাসায় ফিরে মকবুল সাহেব কম্পিউটার থেকে তার সমস্ত কবিতা ডিলেট করে দিলেন। রাগে তার সারা শরীর জ্বলছে। মকবুল সাহেব আজ নিশ্চিত হলেন- শাহানা নামক মেয়েটির জন্য আজ তার এই অবস্থা। তিনি এ বছর’ই শাহানার সাথে দেখা করতে যাবেন আমেরিকা। মকবুল সাহেব অফিস থেকে ছুটি নিলেন। দুই মাসের মধ্যে আমেরিকা যাবার সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেললেন। এমনকি এক মধ্যরাতে মকবুল সাহেব আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দেন। শাহানা’র জন্য তার এতদিন ধরে লেখা কবিতা গুলো কবিতা হয়ে উঠেনি। এ এক মহা যন্ত্রনা। এখন এই মহা যন্ত্রনা থেকে রক্ষা করবে শাহানা’ই। যদি শাহানা এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিতে না পারে তাহলে শাহানাকে সে হত্যা করবে।
কলিং বেল বাজছে। সকাল দশটা। বাসায় শাহানা একা।
শাহানার স্বামী সন্তান কেউ বাসায় নেই। তারা ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে। এমন সময় কে এলো শাহানা মনে মনে ভাবলো। দরজা খুলে শাহানা মানুষটাকে চোখের পলক পড়ার আগেই চিনতে পারলো। দু’জনের’ই বয়স হয়েছে। আবেগ অনেক কমে গেছে। শাহানা বলল, এতদিন পর তুমি? কেমন আছো? আমার ঠিকানা কোথায় পেলে? মকবুল রেগে মেগে বলল, আমি তোমার কোনো কথার উত্তর দিবো না। তুমি আমার কথার উত্তর দাও। আমি কবিতা লিখতে পারছি না। আমার কবিতার ছব্দ, মাত্রা, ভাষা কিচ্ছু ঠিক নেই। এর জন্য দায়ী তুমি। আজ থেকে তেইশ বছর আগে, যখন তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু তুমি আমাকে বিয়ে না করে অন্য একজন বিয়ে করে আমেরিকা চলে আসছো। কেন আমাকে বিয়ে করনি। তুমি আমাকে বিয়ে করনি বলেই আজ আমি কবিতা লিখতে পারি নি। আজ আমি তোমাকে হত্যা করবো।
শাহানা বলল, মনে করে দেখো- আমাদের বিয়ের ঠিক তিন দিন আগে এক দুপুরবেলা তুমি আমার কাছে এসেছিলে। এসে আমাকে অনুরোধ করেছিলে- আমি যেন তোমার সামনে শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে দাঁড়াই। তুমি আমাকে দেখবে। বিয়ের আগে এরকম নোংরা কথা কি করে বললে?
মকবুল বলল, হুম আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। কিছু কাপড় তোমার সৌন্দর্য ডেকে রেখেছিল। আমি তোমাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমাকে না দেখে আমি কি করে কবিতা লিখি? মনে করে দেখো, আমি তোমাকে বলেছিলাম, শুধু দেখব। স্পর্শ করবো না।
(দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৪