একবার পিরোজপুর গেলাম।
অফিসের কাজে। তিন দিনের জন্য। উঠলাম পিরোজপুর ডাকবাংলোয়। চারপাশে গাছপালা। মাঝখানে ডাকবাংলোটি। ভয়াবহ শীত। সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সন্ধ্যায় ডাকবাংলোয় ফিরলাম। বিদ্যুৎ নেই। কখন আসবে কেউ জানে না। একটা হারিকেন মিটমিট করে জ্বলছে। ঝি ঝি পোকা সমানে ক্লান্তিহীণ ভাবে ডেকেই যাচ্ছে। ডাকবাংলোর বাবুর্চি আর তার বৌ দুজনে মিলে রান্না করছে- মাটির চুলায়। ধোয়ার ঠিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না আমি। চারটা বই নিয়ে আসছি। পড়বো। কিন্তু হারিকেনের আলোয় আর রান্না ঘর থেকে আসা ধোয়ায় পড়তে ইচ্ছা করছে না। আমার চোখ জ্বলছে। আমি বেলকনিতে চুপ করে বসে আছি। আর মশার কামড় খাচ্ছি। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। রান্না কখন শেষ হবে কে জানে!
রাত আট টায় আমাকে ডিনার দেওয়া হলো।
সাদা ভাত। ভাতটা ঝাউ ঝাউ হয়ে গেছে। আমি নরম ভাত খেতে পারি না। আমার পছন্দ ঝরঝরা ভাত। তরকারির অবস্থাও ভালো না। মূরগীর মাংস রান্না করেছে। এমন শক্ত মূরগীর মাংস আমি জীবনে খাই নি। ডাল রান্না করেছে। একদম ফালতু হয়েছে। ডালে লবন দিতেও মনে হয় ভুলে গেছে। কি একটা শাক রান্না করেছে। মুখে দেওয়ার পর মনে হলো ঘাস চিবাচ্ছি। বিদ্যুৎ এখনও আসে নি। কাজের চাপে দুপুরে খাই নি। রাতেও আরাম করে খাওয়া হলো না। খুব রাগ লাগছে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তার পরও ভদ্রতার খাতিরে প্লেটে ভাত নিয়ে কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করলাম। বাবুর্চি তার বৌ এর রান্নার হাত যে কত ভালো সেই গল্প করে যাচ্ছে। একবার নাকি এক মন্ত্রী তার স্ত্রীর রান্না খেয়ে এক হাজার টাকা বকশিস দিয়েছেন।
দরজা বন্ধ করে আমি আমার রুমে এলাম।
লাফ দিয়ে বিছায় গেলাম। পাতলা একটা কম্বল দেওয়া হয়েছে। কম্বলে বাজে গন্ধ। ইচ্ছা করছে কম্বলটা ছুড়ে ফেলে দেই। ঘুম আসছে না। মশার কয়েল জ্বালানোর পরও প্রচুর মশা। কানের কাছে ভন ভন করছেই। মশারী নেই। প্রচন্ড শীতের রাত। ঘুম আসছে না। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। কেমন একটা তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব হয় কিন্তু ঘুম আসে না। আশে পাশে কেউ কথা বলছে ফিস ফিস করে। অথবা আমার মনের ভুল। বিদ্যুৎ আসে নি। ঘরে যদিও একটা মিটমিট করে হারিকেন জ্বলছে, তবু আমার কাছে অন্ধকার মনে হচ্ছে। আমি একজন আধুনিক মানুষ। তবুও কোনো ছাড়াই বেশ ভয় ভয় করছে। নীলার কথা খুব মনে পড়ছে। তাকে সাথে করে নিয়ে এলেই ভালো হতো। মনে মনে বললাম, নীলা তোমাকে ভালোবাসি।
আমার গায়ে কিছু একটা পড়লো।
আমি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম। হারিকেনটা উঁচু করে ধরলাম। দেখি দুইটা সাপ। বেশ লম্বা। দেখেই মনে হলো খুব বিষাক্ত সাপ। আমার জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই সাপ। বিকট এক চিৎকার দিতে চাইলাম। অথচ আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। সাপ দুইটা ফস ফস শব্দ করে ফণা তুলছে। ভয়ের চোটে হারিকেনটা উড়িয়ে মারলাম সাপের দিকে। সাপের গায়ে লাগলো না। হারিকেনের কাচটা ভেঙ্গে গিয়ে হারিকেন আলো বন্ধ হয়ে গেল। আমার সারা শরীর এই শীতের রাতে ঘামে ভিজে গেলো। আমি অন্ধকারেই দিলাম দৌড়। হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুজছি। দরজা খুঁজে পাচ্ছি না। একটা সাপ মনে হলো আমার পায়ের উপর দিয়ে গেলো। অথবা আমিই সাপটাকে পাড়া দিলাম। আমি জ্ঞান হারালাম।
সকালে আমার জ্ঞান ফিরলো।
বাবুর্চিকে ঘটনা বললাম। সে আমার কথা বিশ্বাস’ই করে না। সে বলে এই ডাকবাংলোয় কোনো সাপ নেই। আমি তের বছর ধরে এই ডাকবাংলোয় আছি। তারপরও বাবুর্চি আমার খাতিরে আমার পুরো ঘর একটা লাঠি হাতে নিয়ে সাপ খুঁজে বেড়ালো। কোথাও সাপ খুঁজে পাওয়া গেল না। সকালে আটা রুটি, আলু ভাজি আর একটা ডিম পোজ খেয়ে বের হলাম। সারা দিনে কাজের ব্যস্ততায় গতরাতের কথা পুরোপুরি ভুলেই গেলাম। ডাংবালোয় ফিরলাম রাত আট টায়। রাত বাড়তে থাকলো, আমার ভয়ও চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকলো। আজ রাতে আমার সাথে থাকার জন্য বাবুর্চি একটা দশ বছরের ছেলের ব্যবস্থা করে রেখেছে। তার নাম মঞ্জু মিয়া। মঞ্জু মিয়া আমাকে সাপ থেকে বাচাবে? ভয় থেকে রক্ষা করবে? মাত্র একরাত পার করেছি। আরও দুই রাত আমাকে এখানে থাকতে হবে।
গল্পের ভূমিকা শেষ। এখন মূল গল্পে প্রবেশ করবো।
মঞ্জু মিয়া বলল, আপনে ঘুমান। আমি আছি। ছোট একটা ছেলে আমাকে ভরসা দিচ্ছে! আমি বললাম, মঞ্জু তুমি লেখাপড়া করো? মঞ্জু বলল, না। আমি বললাম, তোমরা কয় ভাই বোন? মঞ্জু বলল, আমরা এক ভাই, এক বোন। বোনটা গত বছর মারা গেছে। আমি বললাম, কিভাবে মারা গেছে? মঞ্জু বলল, আপনি যে খাটে বসে আছেন। এই খাটের নিচেই তার গলা কাটা লাশ পাওয়া গেছিল। কত সহজ ভাবেই না মঞ্জু তার ছোট বোনের মৃত্যুর কথাটা বলল। অথচ অজানা এক ভয়ে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আমি বললাম, মঞ্জু কি বলছো! কে তোমার বোনকে হত্যা করলো? মঞ্জু চুপ করে আছে। আমি বললাম, থাক বলতে হবে না। মঞ্জু বলল, আপনার কি ভয় করছে? আমি বললাম, না। ভয় করবে কেন? মঞ্জু বলল, তাহলে আপনাকে একটু ভয় দেখাই। আমি হারিকেনের আলোয় মঞ্জুকে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করছি। মঞ্জু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমিও কিন্তু আমার বোনের সাথে মারা গেছি।
(দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:১১