আমার বাসার সামনেই ফেনী ফার্মেসী।
ফার্মেসীর মালিক রফিক ভাই। রফিক ভাই আমার বন্ধুর মতোন। তবে তার বয়স আমার চেয়ে বেশী। আমি প্রায়ই ফেনী ফার্মেসীতে আড্ডা দেই। রফিক ভাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। পাঞ্জাবী পড়েন, মুখ ভর্তি দাঁড়ি। মাথায় সারাক্ষন থাকে নামাজের টুপি। রফিক ভাইয়ের চুল আর দাঁড়ি সাদা হতে শুরু করেছে। রাত নয়টা থেকে ফেনী ফার্মেসীতে আমাদের আড্ডা শুরু হতো। দোকানে দুইজন ছেলে ওষুধ বিক্রি করতো। আমরা আড্ডা দিতাম। রফিক ভাই পত্রিকা পড়েন না, টিভিও দেখেন না। আমার কাছ থেকেই দেশের সব খবর নেন। কোনো কারন ছাড়াই উনি আমাকে সব সময় সাংবাদিক বলে ডাকতেন। অবশ্য আমি কিছুদিন পত্রিকা অফিসে কাজ করেছি। আমাদের সাথে আড্ডায় আরও দুই তিনজন থাকে নিয়মিত।
গত বৃহস্পতিবার আড্ডায় রফিক ভাই আমাকে তিনটা প্রশ্ন করলেন, হাসিনা কি খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিবে? রোহিঙ্গাদের শেষ পরিনীতি কি হবে? দেশে ছাত্রলীগের দরকারটা কি? আমি বললাম, রাজনীতির কথা আগে ভাগে কিছুই বলা যায় না। কখন কি হয় কেউ জানে না। তবে আমার ধারনা খালেদা জিয়ার মৃত্যু হয়ে কারাবন্ধী থাকা অবস্থায়। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন হাসপাতালে। এদিকে তারেক তার মাকে দেশে শেষ দেখা দেখতে মনে হয় দেশে আসবে না। দেশে এলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এত সহজে হবে না। ১১ লাখ রোহিঙ্গা থেকে কমপক্ষে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের সাথে মিশে যাবে। আর ভাগ্যবান রোহিঙ্গারা বিদেশ পারি দিতে সক্ষম হবে। মারামারি কাটাকাটির জন্য ছাত্রলীগের দরকার আছে। আওয়ামীলীগ জানে যে তারা বড় ভয়ঙ্কর। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এদের দরকার আছে।
আড্ডা শেষে রফিক ভাই বললেন, আগামীকাল গ্রামের বাড়ি যাবো। সাংবাদিক সাহেব আপনি আমাদের সাথে চলেন। আমার গ্রামের বাড়িটা দেখে আসবেন। রফিক ভাই বিয়ে করেছে দুই বছর হলো। তার একটা ছেলে আছে। ছেলে নতুন হাঁটা শিখেছে। আমি বললাম, আমার কাজ আছে। তবে আগামী বছর সুরভিকে সাথে করে নিয়ে যাবো ইনশাল্লাহ। রফিক ভাই বেশ খুশি হলেন। বিদায় নিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম। গ্রামে গিয়ে রফিক ভাই আমাকে ফোন দিলেন। টুকটাক কিছু কথা হলো। পরের দিন বিকেলে আমাদের মসজিদে মাইকে একটি ঘোষনা হলো-একটি শোক সংবাদ। ফেনী ফার্মেসীর রফিক সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রফিক ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি খুব কষ্ট পেলাম। তার কোনো অসুখ ছিল না। হাস্যজ্জল মানুষ ছিলেন। রফিক ভাইয়ের চিন্তায় সারারাত আমার ঘুম হলো না। বারবার শুধু রফিক ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। একদিন আগে তার সাথে দেখা হলো, কথা হলো। পরের দিন তিনি নেই!
রফিক ভাইয়ের জানাজায় গেলাম না।
তার বাসায় গেলাম। ভাবী বললেন, গ্রামে যাওয়ার সময় সব সময় আমরা লাগেজে করে আমার সমস্ত গহনা সাথে করে নিয়ে যাই। আপনার ভাই খালি বাসায় গহনা রেখে যেতে চাইতেন না। এবারও গ্রামে যাওয়ার সময় লাগেজে করে সমস্ত গহনা নিয়ে গেলাম। বাসে আমরা সব সময় লাগেজ আমাদের পায়ের কাছে রাখি। এবার বাসের কন্টাকটর অন্যান্য যাত্রীদের মালামালের সাথে গাড়ির ডেকে আমাদের লাগেজ রেখেছে। ফেনী থেকে ঢাকা আসার পথে অনেক যাত্রী কুমিল্লা নেমে যায়। কুমিল্লায় নেমে যাওয়া এক যাত্রী আমাদের লাগেজ নিয়ে যায়। ঐ যাত্রীর দোষ নেই। বাসের কন্টাকটর ভুলে আমাদের লাগেজ দিয়ে দেয়। দু'টা লাগেজ দেখতে একই রকম। আমরা বাস থেকে সায়দাবাদ নেমে দেখি, আমাদের লাগেজ নেই। কন্টাকটর আমাদের অন্য লাগেজ দেয়। লাগেজ খুলে বুজতে পারি লাগেজ বদলে গেছে। দীর্ঘ দিনের কষ্ট করে জমানো সঞ্চয় আমাদের সব শেষ।
ভাবী কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলে যাচ্ছেন।
সায়দাবাদ নেমে রফিক বাস কাউন্টারের সামনে বাসের ড্রাইভার আর কন্টাকটের সাথে অনেক কথা কাটাকাটি করে। ওখানকার লোকজন পারলে রফিককে মারে এমন অবস্থা। একসময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। রফিক মাটিতে পড়ে যায়। সাথে তাকে ঠান্ডা পানি খাওয়ানো হয় এবং মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালা হয়। তাতে রফিকের কোন উপকার হয় না। বরং হাঁসফাঁস আরো বেড়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলো না। সাথে সাথে মুগদা হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডাক্তার জানালেন দশ মিনিট আগে মারা গেছেন।
মানূষের মৃত্যু কোনো ঘটনাই না আজকাল। যে কোনো সময় যে কেউ মরে যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৪২