(এই লেখাটি আমার নয়। এটা লিখেছেন আমার শ্বশুরমশাই। তার অনুমতি নিয়েই লেখাটি ব্লগে দিলাম।)
১৯৯৬ সালে সরকারী কর্মচারীদের নিয়ে তত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের অংশ হিসাবে জনতার মঞ্চে গেলাম। এরি ফলশ্রুতিতে আওয়ামিলীগ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারন নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে ২১ বছর পর রাষ্ট পরিচালনার দায়িত্ব পেল। আমরা যারা জনতার মঞ্চে গেলাম তারা হিরো অব দ্যা হিষ্টরীতে রুপান্তরিত হলাম। ইত্যবছরে সময়ের পরিক্রমায় আমি বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হলাম। মোঃ মজিবুল হক মহাসচিব হলেন।
১৯৯৯ সালে সরকারী কর্মচারীদের দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে বিএনপি পন্থি কর্মচারী সংগঠনের নেতা আলম- খালেকদের সাথে আন্দোলনের ঐক্য গঠিত হলো। আমরা কর্মচারীদের দাবী দাওয়া সরকারের নিকট পেশ করলাম এবং একটি আল্টিমেটাম দিলাম। এখানে উল্লেখ্য যে, অতি সরকারপন্থি কতিপয় দুষ্টচক্র এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে ষড়যন্ত্রের জাল বুনা আরম্ভ করলো। তারা মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর দপ্তরের পিএস ও এপিসদের সাথে রাতের আধারে আঁতাত করে আমাদেরকে আন্দোলন নস্যাৎ করার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
যাহোক, আমাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে ভুল বার্তা দিয়ে বিষিয়ে তুলল। আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মুলক মিথ্যা মামলা দায়ের করল। ১ লা আগষ্ট, ১৯৯৯ তারিখ রোববার সচিবালয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম কাজ করানো হলো অর্থাৎ ডকস্কট দিয়ে কর্মচারীদের চেকিং করা হলো। আমি সচিবালয়ে প্রবেশের সময় তৎকালীন আব্দুল গনি রোড গেইটে কর্তব্যরত পুলিশ সার্জন মিজান আমাকে বলল- ভাই ভিতরে যাবেন না তা হলে সমস্যা হবে। আমি তাকে বললাম- সচিবালয় আমার অফিস সেখানে কেন আমি যাবো না। এরপর আমি আমার কর্মস্থল পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে গেলে পানি সম্পদমন্ত্রী আঃ রাজ্জাক সাহেবের পিএস আরিফ সাহেব এসে আমাকে বললেন - স্যার আপনাকে খুঁজছেন। আমি রাজ্জাক ভাইয়ের অফিসে গেলে তিনি আমার কাছে স্ববিস্তারে জানতে চান। আমি সবই বললাম, এরপর ওনি আমাকে রুমে অবস্হানের পরামর্শ দিয়ে বললেন, তুমি আমাদের লোক, সুতরাং সমস্যা অবশ্যই সমাধান করতে হবে।
কুচক্রী মহল রাজ্জাক সাহেবের উদ্যোগ আঁচ করতে পেরে দ্রুত আমাকে গ্রেফতার করালেন। যা হবার তাই হলো। কর্মচারীরা খুদ্ধ হয়ে অনেক ভাংচুর করলো। আমাকে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। একে একে, চতুর্থ শ্রেনী নেতা মিজানুর রহমান, নিজাম, আলাউদ্দিন, আবাসন অধিদপ্তরের একজন কর্মচারীকে থানায় আনা হলো। আমার বদ্ধমূল ধারনা ছিল আওয়ামী লীগ সরকার আমার সাথে বৈরী আচারণ করবে না। এ বিশ্বাসের কারনে রাতে বিএনপি নেতা ব্যারিষ্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আমার সাথে দেখা করে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার সাথে মোবাইলে হ্যালো বলবার অনুরোধ করলে তা আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি, যা আজও কাউকে বলা হয়নি। তিনি আমাকে বললেন- আলম ভাই, আপনি শুধু ম্যাডামকে হ্যালো বলবেন, আপনার যাবতীয় দায়িত্ব বিএনপি নিবে। আমি তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করি। আমার আন্দোলনের ফসল সরকার, আমার সাথে কি আচরণ করেছে তৎকালীন চাকুরীজীবিদের স্মৃতির মনিকোঠায় অবশ্য অম্লান রয়েছে।
পরের দিন বিকেলে প্রিজনভ্যানে আমাদের চারজনকে আদালতে নেয়া হলে সেখান থেকে গভীর রাতে কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরীত হলাম।জীবনের নতুন বাঁকে শুরু হলো আর একটি অধ্যায়।
৩ রা আগষ্ট, ১৯৯৯ তারিখ রাত ১২ টায় জেল গেইটে পৌঁছলাম।
ডেপুটি জেলার ফরমান আলী আমাকে বসার জন্য একটি চেয়ার দেন এবং অন্য সাথীদের একটি বেঞ্চে বসার ব্যবস্হা করলো। অতঃপর আমাদের চারজনকে চা- বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। সকল আসামী গননা করার পর আমাদেরকে একজন মিয়াসাব (জেল সিপাই) কে বলল, এরা বিশেষ মেহমান। আমদানিতে কর্মরত ম্যাটকে বলবে- জানালার পাশে ভালো জায়গায় বিছানার ব্যবস্হা করতে। যে আদেশ ততমতে বিছানা হলো।
রাতে একটুও ঘুম হলো না।
ফজরের আযান হওয়ার সাথে সাথে আমি ওজু করে নামাজ সেরে নিলাম। ঐদিন ৪ ঠা আগষ্ট, ১৯৯৯ দেখলাম জেলের রাজা জেলার সাহেব সুর্য্য উঠার আগেই আমদানির বারান্দায় শাহী আয়েশে এসে বসলেন। একজন কয়েদি বিশাল হাতপাখা দিয়ে জেল রাজকে বাতাস দিচ্ছে। সকল আমদানীর আসামি তার সামনে ফ্লোরে মাথা নত করে বসে আছে, তখন জেলরাজ এক একজনকে নাম ধরে ডাকে এবং তাদের পোষ্টিং দিতে থাকে। সর্বশেষে আমার ও আমার সাথীদের পালা।
প্রথম আমাকে ওনি জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কি, আমি নাম বলার সাথে সাথে বললেন- ও আপনিই শাহ আলম? আমি বললাম হ্যা। তখন সে বলল, আপনি আমার কয়েক দিনের মেহমান। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে আপনার অমর্যদা হবে না। এই বলে আমার সাথে আবাসন পরিদপ্তরের ঐ লোকটাকে আমার সাথে দশ সেলে প্রেরণ করে এবং মিজান ও নিজামকে বিশ সেলে প্রেরণের আদেশ দিয়ে চলে গেলেন।
আমি দশ সেলে গেলাম, সেখানে গিয়ে মিরপুরের বি,এন,পি নেতা নিউটন ও লালবাগের যুবদলের এক নেতাকে দেখতে পেলাম। নিউটন আমাকে বলল, বড় ভাই- আপনি এখানে কেন, আপনিতো জনতার মঞ্চে গেছেন। এটা ছিল ওর ব্যাঙ্গোক্তি। যা হোক অল্প সময় পরে আমাকে নেয়া হলো পানিশমেন্ট সেল পনরতে। আমার মনে হলো আমি বেহেশত থেকে দোজখে পৌঁছলাম।
আমার ঠিকানা হলো জেলখানায় ১৫ সেলে। যেখানে বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুভ্রত বাইন, লালবাগের সেভেন মার্ডারের আসামী নাটকা বাবু, সেভেন ষ্টার গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড মগবাজারের শীর্ষ সন্ত্রাসী টিক্কার কক্ষে। ছোট্ট একটা কোঠরীতে আরও দুজন ছিল তন্মধ্যে ডাকাতি মামলার আসামী মনা ও ছিনতাই মামলার আসামী মুন্না। সুভ্রত বাইন জেলখানায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ফতেহ আলী খা নামে অভিহিত হলো। ও নামাজ পড়া না জানলেও প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে জিকির করতো যা দেখার মতো ছিলো। আমাকে খুব সকালে ও ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বলত ভাই ফজরের নামাজ পড়ে নিন। রুমটা এতটা ছোট ছিল আমার নামাজ পড়ার সময় আরও দুজনের উঠে বসে থাকতে হতো। আমার নামাজ আদায়ের পরে ওরা আবার ঘুমাতো। আমি সন্ত্রাসীদের নামাজীর প্রতি এতো ভক্তি শ্রদ্ধা দেখে মোহিত হয়ে যাই। আমাদের কক্ষে মুন্না সারারাত হাত পাখা দিয়ে বাতাস দিত এবং মনা জেলখানায় অভিনব কায়দায় জ্বালানী দিয়ে ডিম ভাঁজি ও ডাল চটচটি করে খাওয়াত। আমি জেলখানার ডাল চটচটির স্বাদ আর কোথাও পাইনি।
একে একে খাদ্য মন্ত্রনালয়ের খলিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরোয়ার, পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওমর ফারুক স্হানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আলাউদ্দীনসহ বেশ কয়েকজন জেলখানায় আসার সংবাদ পেলাম। সর্বশেষে দেখলাম একদিন রাত আনুমানিক দশটার সময় কেয়ার টেকিং ইউনিটের শাহাবুদ্দিন আমার কক্ষের সামনে দিয়ে হাতে একটি পুটলি নিয়ে যাচ্ছে, আমি তাকে ডাক দিলে ঝরঝর করে চোখের জ্বল ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি তাকে বললাম, দাঁড়াও। আমার রুম থেকে কিছু শুকনো খাবার দিয়ে বললাম, রাতে খেয়ে নিও। কারন জেলখানায় পাঁচটায় খাবার দিয়ে থাকে। সুতরাং তুমি আজ কোনো খাবার পাবে না। সে নীরবে খাবার হাতে নিয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে চলে যাওয়ার প্রাক্কালে আমি বললাম, সকালে আমার সাথে নাস্তা করবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, আমার দুই রুম পরে যশোর উদীচী হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামী হাসানকে সরকার একা একটি রুমে রেখেছেন। হাসান আবার নিয়মিত নামাজ পড়ার সুবাধে আমার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। প্রত্যহ সকালে তার সাথে একত্রে আমি নাটকা বাবু, সুভ্রত, টিক্কা নাস্তা খেতাম। পরের দিন সকালে শাহাবুদ্দিনও আমাদের সাথে নাস্তায় অংশ নেয়। হাসানের নাস্তায় পাঁচ ছয় ধরনের দেশী-বিদেশী ফলের সমাহার ছিল, যা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করার কথা নয়।
জেলখানায় পনর সেলের যে ম্যাট ছিল (ম্যাট তারাই হয় যারা সাজাপ্রাপ্ত আসামী) তিনি জনতা ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্হাপক ছিলেন। দুর্নীতির দায়ে তার দশ বছর সাজা হয়। তিনি অত্যন্ত পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। নিয়মিত জেল লাইব্রেরী থেকে বই এনে পড়তেন, মাঝে মধ্যে আমাকে বই দিয়ে সাহায্য করতেন এবং সময় পেলে আমার সাথে গল্প করতেন। তিনি সাইন্সে গ্রাজুয়েট ছিলেন। ম্যাটদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ ছিলো। তার দায়িক্ত হলো প্রত্যহ সকালে এবং বিকেলে রুমের আসামি গুনে কতৃপক্ষের নিকট রিপোর্ট দেয়া। এ ছাড়া আসামীদের একটি ফাইল তার কাছে এবং আদেশ নির্দেশ তার মাধ্যমে আমরা জানতে পারতাম।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২০ সকাল ১১:০৫