আমি এখন যে কথাটা বলবো, তা কেউ বিশ্বাস করবে না।
অবশ্য এই কথাটা আমাকে কেউ বললেও, আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না। অনেক কিছু ঘটে যা দেখা যায় না, তবে অনুভব করা যায়। কোনো কোনো ভাগ্যবান বা দূর্ভাগ্যবান তা দেখতে পায়। এই আধুনিক যুগে এসে এরকম কথা বিশ্বাস করার কোনো কারনও নেই। শাহেদ জামাল বিশ্বাস করে, লজিক'ই দুনিয়াতে সব না। লজিকের বাইরেও অনেক কিছু ঘটে। যা বিজ্ঞান দিয়ে আবিস্কার করা যাবে না। এই যে এখন বাজে সকাল এগারোটা। শাহেদ জামাল বসে আছে রমনা পার্কে। তার পাশে চুপ করে বসে আছে শফিক। অথচ শফিক মারা গেছে তিন বছর হয়ে গেছে। শফিককে কেউ দেখতে পায় না, শুধু শাহেদ জামাল দেখতে পায়। এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস করার মতো কথা এটা? বিষয়টা নিয়ে শাহেদ জামাল বেশ চিন্তিত।
শফিক কিছু বলে না। চুপ করে বসে থাকে।
শাহেদ জামাল কিছু জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে শফিক সৌদি চলে যায়। তার সৌদি যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু সংসারের অভাবের কারনে যেতে বাধ্য হয়েছে। টানা সাত বছর সে সৌদি থেকেছে। দেশে বাপ, মা, ভাই-বোনকে টাকা পাঠিয়েছে। নারায়নগঞ্জে একটা জমি কিনে বাড়ি করেছে। শফিক সৌদি গিয়েও নিয়মিত শাহেদ জামালের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলে কথা বলেছে। শাহেদ জামাল আর্থিক সমস্যা পড়লে চাওয়ার আগেই সফিক টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। শফিকের জন্য তার মা একটা মেয়ে দেখে রেখেছে। শফিক ফিরবে। তার বিয়ে হবে। সব ঠিকঠাক। শাহদ নিজেও কুমিল্লা গিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলে এসেছে। লক্ষ্মী একটা মেয়ে। দেখতে ভীষন মিষ্টি। শফিক দেশে ফেরার দুই দিন আগে স্ট্রোক করে মরে যায়। এই মৃত্যু শাহেদ জামালকে খুব কষ্ট দেয়।
শাহেদ জামাল বললো- তুই চাস কি?
শফিক কিছু বলে না। শাহেদ জামাল বলে, ইদানিং আমাকে খুব বেশি দেখা দিচ্ছিস। ঘটনা কি? সেদিন বিকেলে চায়ের দোকানে চলে এলি। আজ রমনা পার্কে। এর মধ্যে তুই একদিন আমার বাসায়ও চলে এসেছিস। বাসায় কেউ ছিলো, কি প্রচন্ড ভয়ই না পেলাম আমি। তুই আমাকে ভয় দেখাছ ক্যান? কিছু একটা বল, চুপ করে আছিস ক্যান? তোর জন্য তো কোথাও গিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। তুই কি আমাকে কিছু বলবি? কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। আমি তোর বাবা, মা, ভাই-বোনদের সাথে যোগাযোগ রেখেছি। মাসে একবার তাদের বাসায় যাচ্ছি। ফোনেও খোঁজ খবর নিচ্ছি। তারা সবাই ভালো আছেন। শফিকের কোনো কথা নাই। সে চুপ করে আছে। শাহেদ জামালের খুব রাগ লাগছে। রেগে গিয়ে বলল, তুই আমার সামনে থেকে যা। অন্য কোনো বেঞ্চে গিয়ে বোস। আমি তোর জন্য পা মেলে শুতে পারছি না। শফিক উঠে অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসলো। সম্ভবত সে শফিক রাগ করেছে।
শাহেদ জামাল ঘুমিয়ে পড়লো।
পার্ক ঘুমানোর জন্য খুব সুন্দর জায়গা। শীতল বাতাস। নানান রকম পাখির ডাক। বিরক্ত করার কেউ নেই। গতকাল রাতে শাহেদ জামাল একটুও ঘুমায় নি। Parasite মুভিটা দেখেছে। এই মুভি সে আগেও আরও দুইবার দেখেছে। মুভির কাহিনী এই রকমঃ স্ত্রী এবং দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে টানাপোড়েনের সংসার। কর্মক্ষম হলেও দুর্ভাগ্যবশত চারজনেই তারা বেকার। আক্ষরিক অর্থেই এক অন্ধকূপে আটকে গেছে তাদের পরিবার। এক পরিবার বসে বসে যে বৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করছে, ভাগ্যের পরিহাসে সেই বৃষ্টির তোড়েই আরেক পরিবারের স্বপ্ন ভেসে যাচ্ছে। কোনো নৈতিক মূল্যবোধ না থাকলেও মুভির চরিত্রগুলোর প্রতি একটি অদ্ভুত টান অনুভব করেছে শাহেদ। মুভিতে চরিত্রগুলোর যে মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে, বাস্তবে এরকম কিছু ঘটা অসম্ভব কিছু না। মুভি শেষ হয়েছে রাত সাড়ে তিনটায়। তারপর শফিক বাতি নিভিয়ে বিছানায় গিয়ে দেখে পুরো ঘর আলোকিত। আকাশে বিশাল এক চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোতে ঘর আলোকিত হয়ে গেছে। শাহেদ জামাল বারান্দায় গিয়ে চাঁদের আলো উপভোগ করলো। ঘুমহীন একটি রাত পার করলো।
শাহেদ জামালের ঘুম ভাঙ্গল সাড়ে তিনটায়।
মৃত শফিককে আসে পাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শাহেদ জামাল শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তবে তার বেশ ক্ষুধা লেগেছে। সকালে নাস্তা না করেই সে বাসা থেকে বের হয়েছে। পকেট ফাঁকা। অথচ খুব ক্ষিদে পেয়েছে। শাহেদের এখন খেতে ইচ্ছা করছে বিরানী। পকেটে টাকা থাকলে সে এখন পুরান ঢাকায় চলে যেত। ইচ্ছে মতো খেতো। খাওয়া শেষে এক বোতল ঠান্ডা কোক। এক চুমুক কোক, আর একটা সিগারেটে লম্বা টান। পকেটে টাকা না থাকলেই শুধু খাওয়ার কথা মাথায় আসে। শাহেদ জামাল কোনো পথ না দেখে নীলাকে ফোন দিলো। বলল, আমার মোবাইলে টাকা নেই। ফোন কেটে যাবে। তুমি কি আমাকে একটা ফোন দিবে, প্লীজ? সাথে সাথেই নীলা ফোন করলো। শোনো, তুমি চানখারপুল আসো। আর শোনো কিছু টাকা সাথে করে নিয়ে এসো। নীলা বলল, এখন পর্যন্ত কত টাকা নিয়েছো সেই হিসাব আছে? শাহেদ জামাল বলল, হিসাব তুমি রাখো। সুদে আসলে সব পেয়ে যাবে খুব শীঘ্রই।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:০২