আমার মনে'ই হয় না আব্বা মারা গেছে।
মনে হয় দরকারী কাজে ঢাকা বাইরে গেছে, কিছু দিনের মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু সত্য হলো ৪/৫ মাস হয়ে গেছে আব্বা মারা গেছে। এ মাসের ১ তারিখ ছিলো আব্বার জন্মদিন। একসময় আমরা সবাই মিলে খুব ধূমধাম করে আব্বার জন্মদিন পালন করতাম। অনেক মজা হতো। মাঝে মাঝে আমরা আব্বার জন্মদিনে সকলে মিলে গ্রামে যেতাম। খুব মজা হতো। অবশ্য গত দশ বছর আব্বা তাঁর জন্মদিন পালন করে নাই। কারন আব্বার জন্মদিনে আমার দাদা মারা যান। সেই থেকে আব্বা তাঁর জন্মদিন পালন করে নাই। বরং জন্মদিনে আব্বা মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াতে। দাদার কবর জিয়ারত করতো। গ্রামে মিলাদ পড়াতো। গরীবদের খাওয়াতো।
সেদিন আব্বাকে স্বপ্নে দেখলাম।
দেখি আব্বা দুইটা বিশাল তরমুজ নিয়ে বাসায় আসছে। আব্বা বলল, তরমুজটা কাট। আয় সবাই মিলে খাই। আমি তরমুজ কাটলাম। টকটকা লাল তরমুজ। আর কি মিষ্টি! আব্বাকে তরমুজ দিলাম। আব্বা খেলো না। বলল, তুমি চুল কাটাচ্ছো না কেন? চুল দিয়ে কান ঢেকে গেছে। যাও এখনই চুল কেটে এসো। আমি বললাম, শুক্রবার কাটাবো। আব্বা বলল, পত্রিকাটা দে তো, পড়ি। দেখি দেশের কি অবস্থা? আমি বললাম, পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছি। আব্বা বলল, তাহলে টিভিটা ছেড়ে দে, খবর দেখি। আমি টিভি ছেড়ে দিলাম। আব্বা বলল, খুব ঠান্ডা লাগছে। এসিটা কমিয়ে দে। স্বপ্ন এতটুকুই। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম ভাঙ্গার পর মনটা খুব খারাপ হলো। মোবাইলে আব্বার ছবি বের করে দেখলাম।
আব্বা ছিলো খুব সৌখিন মানুষ।
সে তাঁর বাসায় পরা লুঙ্গিটা পর্যন্ত দোকান থেকে আয়রন করিয়ে আনতো। কোনো দিন আব্বাকে এলোমেলো অবস্থায় দেখি নাই। সে সব সময় টিপটপ থাকতে পছন্দ করতো। প্রতিদিন দাঁড়ি কামাতো। আব্বা প্রতিটা ঋতুতে নতুন জামা কাপড় বানাতো। প্রতি বছর শীতে দুইটা করে কমপ্লিট স্যুট বানাতো। আব্বা কোনো দিন নিজের জন্য এবং আমাদের জন্য সস্তা কিছু কিনতো না। ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় মার্কেট থেকে কেনাকাটা করতো। আমি আব্বার সাথে সবচেয়ে বেশী বাজারে গিয়েছি। আব্বাকে কখনও কোনো জিনিস কেনার সময় দামাদামি করতে দেখি নি। পছন্দ হয়েছে, নিয়ে নিয়েছে। বাজার শেষ করে আব্বা আমাকে বার্গার আর কোক খাওয়াতো। কিন্তু বলতো কোক বার্গার খাওয়ার চেয়ে ফল খাওয়া ভালো।
আমি বড় হয়ে গেছি। বিয়ে করে ফেলেছি।
তবু আব্বা আমাকে জোর করে ধরে সেলুনে নিয়ে যেত। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চুল কাটাতো। কখনও রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো- হাত ধরে রাস্তা পার করে দিতো। রিকশা ঠিক করে দিত। ছোটবেলা থেকেই আমার দাঁতে সমস্যা। দাঁতের ডাক্তারের কাছে যেতে আমার ভয় করে। আব্বা আমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। বলতো ভয় নেই। আমি আছি। তোমার হাত ধরে রেখেছি। আর ডাক্তার যদি তোমাকে ব্যথা দেয়, ডাক্তারের কানটা টেনে ছিড়ে ফেলবো। চিনে আমাকে! বাসায় ফেরার পথে আব্বা আইসক্রীম কিনে দিতো। আমি বাচ্চা ছেলেদের মতোন আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফিরতাম। আমার অন্য তিন ভাইয়ের চেয়ে আব্বা আমাকে বেশী পছন্দ করতো। বেশী ভালোবাসতো।
আব্বাকে আমি খুব মিস করি।
কাঁধে হাত রেখে কেউ বলবে না- কি রে, মন খারাপ? বিরানী খাবি? চল। বিরানী খাওয়া শেষে বলতো- তোকে একটা জুতো কিনে দেই। জুতোর কথা বলে শার্ট প্যান্টও কিনে দিতো। আব্বা বলতো- সব সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকবি। কখনও যেন মাথার চুল এলোমেলো না থাকে। জামা ইন করে পরবি। জুতোয় যেন ময়লা না থাকে। সব সময় সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবি। দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করবি। কেউ সাহায্য চাইলে কখনও ফিরাবি না। পকেটে যা থাকবে দিয়ে দিবি। দেখবি, তাতে অনেক আনন্দ পাবি, শান্তি লাগবে। আব্বাকে সব সময় দেখতাম, ভিক্ষুকদের কখনও ৫/১০ টাকা দিতো না। ১০০ শ' টাকা করে দিতো।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০২১ দুপুর ১২:০৬