সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বিশাল উপন্যাস আছে। নাম- 'পূর্ব পশ্চিম'। বাংলাদেশের কোনো লেখক এত বড় উপন্যাস লিখেন নি। হ্যাঁ আমাদের ইমদাদুল হক মিলন 'নূর জাহান' নামে একটা বড় উপন্যস লিখেছেন। সেটা থেকে অনেক বড় এই 'পূর্ব পশ্চিম' দুই খন্ডে প্রকাশিত। কলকাতার বই গুলো বাংলাদেশের মতন নয়। বাংলাদেশের ফ্রন্ট সাইজ অনেক বড় বড়। আর কলকাতার ফ্রন্ট সাইজ খুবই ছোট। যাইহোক, অনেক বছর আগে আমি সুনীলের 'পূর্ব পশ্চিম' বইখানা পড়ি। এই তো কিছুদিন আগে সুনীলের 'পূর্ব পশ্চিম' আবার পড়লাম। টানা পড়ে গেছি। দুই মাস সময় লেগেছে। প্রথম বারের চেয়ে এবার বইটা পড়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি। এজন্য আমি সবাইকে বলি- ভালো ভালো বই গুলো দুই তিনবার করে পড়া উচিৎ।
'পূর্ব পশ্চিম' বইতে কি আছে? আছে ইতিহাস। আছে, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার কথা। আছে দেশভাগের কথা। ভাষা আন্দোলনের কথা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। আছে নকশাল আন্দোলনের কথা। লাখ লাখ উদ্বাস্তুদের জীবনযাত্রার কথা। বইটাতে আছে অজপাড়া গায়ের কথা, ঢাকা শহর ও কলকাতার কথা। আছে লন্ডন থেকে শুরু থেকে আমেরিকার কথা। আছে রাজনীতির জটিল সমীকরন। লেখক বইটি একজন নিরপেক্ষ ভাবে লিখেছেন। ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস হলেও, বইটাতে একটা গল্প আছে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে লেখক ইতিহাস বলে গেছেন দারুন মুন্সিয়ানায়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র প্রতাপ। প্রতাপ মজুমদার। যার বাড়ি বাংলাদেশের বিক্রমপুরের মালখা নগর গ্রামে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাকে চলে যেতে হয় কলকাতায়। প্রতাপের স্কুল জীবনের বন্ধু মামুন। যার ভালো নাম মোজ্জামেল। উপন্যাসের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র বলা যেতে পারে।
লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপন্যাসে হিন্দু মুসলিমদের দাঙ্গার কথা লিখেছেন। দাঙ্গার ফলে মানুষের জীবনে কি চরম অবস্থা বিরাজ করেছে সেটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। দেশভাগের ফলে যে জটিল কুটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা লেখক লিখে গেছেন বিনা দ্বিধায়। 'পূর্ব পশ্চিম' উপন্যাসে লেখক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বিস্তারিত ভাবে এনেছেন। পাকিস্তানীদের অত্যাচারের কথা লিখেছেন। আমাদের দেশের সাহসী যোদ্ধাদের কথা লিখেছেন। বিশেষ করে জাহানারা ইমামের বড় ছেলে রুমী। এবং টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দীকির কথা সবিস্তারে লিখেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে আমাদের দেশের লেখকদের অনেক গল্প উপন্যাস আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত কেউ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো করে লিখতে পারেন নি। পার্থক্য হলো- সুনীল তার উপন্যাসে কাউকে তেল দেয়নি। চাটুকারিতা করেন নি। সুনীল বলেছেন, শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী দেশে ফিরে এসে যথাযথ পদক্ষেপ গুলো নিতে পারেন নি।
এই উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনের কথা এসেছে। কিছু কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে বিপ্লব শুরু করে। নকশাল আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য ভালো ছিলো। কিন্তু নকশালকারীরা বুঝেনি, গুপ্ত হামলা করে জয়ী হওয়া যায় না। ফলাফল, অল্প বয়সী কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে গুলো বিনা বিচারে মরেছে। জেল খেটেছে। এবং তাদের পরিবার কেঁদেছে। তবে নকশালকারীরা সফল না হলেও বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পেরেছে। 'পূর্ব পশ্চিম' উপন্যাসে শরনার্থীদের কথা বিশদভাবে এসেছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে লাখ লাখ উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে। ভারত সরকার তাদের থাকার জায়গা দিয়েছে। খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর বহু দেশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন। পাকিস্তানীরা কিভাবে অত্যাচার করছে সে সব নিয়ে বিশ্ব দরবারে জানিয়েছেন। সাহায্য চেয়েছেন। উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ন ভাবে তাজউদ্দীন সাহেবের কথা এসেছে। কিন্তু আপনারা খেয়াল করে দেখবেন, কখনও আওয়ামীলীগের মুখে তাজউদ্দীন সাহেবের নাম আসে না।
'পূর্ব পশ্চিম' উপন্যাসে লেখক তার চরিত্র গুলো দিয়ে অনেক মূল্যবান কথা বলে দিয়েছেন। এই উপন্যাসে একটা চরিত্র আছে নাম হারিত মন্ডল। দারুন এক চরিত্র। চরিত্রটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এই উপন্যাসে অনেক গুলো চরিত্র থাকলেও কোথাও কোনো জট পাকায় নি। লেখক উপন্যাসের শেষের দিকে স্পষ্ট বলেছেন, শেখ মুজিব রাজাকারদের সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করেছেন। তার কাছের লোকেরা চরম দূর্নীতি করেছে। শুরু করেছে অরাজকতা। যুদ্ধের পর সঠিকভাবে দেশ পরিচালনার অভাবে দেশের মানুষ ভালো ছিলো না। শেখ মুজিব সেদিকে নজর দেন নি। লেখক বলেছেন, তিনি (শেখ মুজিব) স্বাধীন দেশে বেঁচে ফিরে এসেছেন এবং দেশের প্রধান ব্যাক্তি হয়েছেন এই খুশিতে তিনি আত্মহারা। এদিকে দেশের মানুষ সীমাহীন অভাবে পড়েছেন।