সোলেমানকে সবাই বলে আড়ৎধার।
ওয়াজই ঘাটে তার বড় আড়ৎ আছে। ফলের আড়ৎ। ভোর থেকে তার বেচাকেনা শুরু হয়। বেলা বারোটা বাজার আগেই বেচাবিক্রি শেষ। আড়ৎ থেকে প্রতিমাসে অনেক টাকা ইনকাম হয়। দুপুরের তার আর কোনো কাজ থাকে না। সে বাসায় চলে আসে। সে সময় ছেলেমেয়ে বাসায় থাকে না। তাঁরা স্কুলে। সোলেমান স্ত্রীকে রান্নার কাজে সহযোগিতা করে। তার স্ত্রী পুরান ঢাকার মেয়ে। ঠমক আছে। তার স্ত্রী ঢাকাইয়া ভাষায়ও কথা বলতে পারে, আবার শুদ্ধ বাংলায়ও কথা বলতে পারে। তাদের ছিলো প্রেমের বিয়ে। সোলেমানের সুন্দর পরিবার। সহজ সরল জীবনযাপন।
সোলেমানের যখন যা মনে আসে তাই করে।
একদিন সোলেমান বাজারে গিয়ে একদম দেশী কই মাছ পেয়ে যায়। আজকাল তো দেশী মাছ পাওয়াই যায় না। সোলেমান টোমেটো কিনলো। আর কিনলো মটরশুটি। কই মাছ, মটর শুটি দিয়ে খেতে দারুন লাগে। সাথে টোমেটো দিলে তো কথাই নাই। খেতে দুর্দান্ত হয়। ওয়ারী থানার সামনে এক বন্ধুর সাথে দেখা। সোলেমান তার সাথে গল্প করলো চা খেলো। তারপর রাত নয়টায় বাসায় ফিরলো। স্ত্রীকে বলল, ভাগ্য ভালো আজ দেশী কই মাছ পেয়েছি। কই মাছ রান্না করো। মাছটা হালকা ভেজে নেবে। মাখা মাখা করে রান্না করবা। এক পাতিল ঝোল দিবা না।
সোলেমানের স্ত্রী বলল, ফাজলামো পেয়েছো?
এত রাতে আমি মাছ রান্না করতে পারবো না। মূরগী রান্না করেছি, চিচিঙ্গা ভাজি করেছি। ঘন করে ডাল করেছি- তাই দিয়েই রাতে খাও। আগামীকাল কই মাছ রান্না করে দিবো। সোলেমান প্রচন্ড রেগে গেলো। তখন তার ছেলেমেয়ে এসে বলল, বাবা তুমি ক্যান শুধু শুধু ঝামেলা করো। এই ছোট কই মাছ মা কাটতেই পারবে না। সকালে বুয়া এসে কেটে দিবে। দুপুরে খেও। সোমেলাম বলল, তোমরা কেউ'ই আমার আপন না। তোমরা আসলে আমাকে ভালৈ বাসো না। এমন কোনোদিন হয়েছে, যে তোমরা কিছু চেয়েছো আর আমি দেইনি? ওকে। যা বুঝার আমি বুঝে গেছি। আমার আর কাউকে লাগবে না।
রাত একটা। সোলেমান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
সে এদের সাথে আর বাস করবে না। সে গ্রামে ফিরে যাবে। ভোরবেলাতেই সে গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। তার বাড়ি বিক্রমপুর। শ্রীনগর থানা। গত বিশ বছর সে গ্রামে যায়নি। গ্রামের বাড়ি ঘরের কি অবস্থা কে জানে! আজ সে তার স্ত্রীর সাথে ঘুমাবে না। সে সারারাত ব্যলকনিতে কাটিয়ে দেবে। তবে ব্যলকনিতে মশা আছে। বড় বড় জংলি মশা। ভোর পাঁচটায় সোলেমান তার ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। স্ত্রীকে ডেকে বলল, আমি চললাম। তোমরা ভালো থেকো। ছেলেমেয়ে ঘুম থেকে উঠেছে। তাঁরা বলল, বাবা সাবধানে যেও। সোলেমান বলল, থাক তোমাদের আর জ্ঞান দিতে হবে না।
একসময় বিক্রমপুর যেতে সময় লাগতো- ৭/৮ ঘন্টা।
এখন সময় লাগে মাত্র এক দেড় ঘণ্টা। কি সুন্দর রাস্তা হয়েছে। গ্রামের নাম কামারগাও। কামারগাও বাজারের পেছনেই পদ্মানদী। নিজের গ্রামের বাড়িতে এসে সোলেমান অবাক! পুরো বাড়ি জঙ্গল হয়ে আছে। দরজা জানালা কিছুই নেই। কিছু না থাকুক। তবুও তো নিজের বাপ দাদার ভিটেমাটি। লোক লাগিয়ে পুরো বাড়ি পরিস্কার করতে কমপক্ষে ৭ দিন তো লাগবেই। লাগুক। সোলেমান ভাবলো তাড়াহুড়ার কিছু নেই। আলামিন বাজার থেকে দশজন লোক নিয়ে এলো। তাঁরা বাড়ি পরিস্কারের কাজ শুরু করে দিলো। সোলেমান নিজেও হাত লাগালো।
সোলেমান উঠানে বসে আছে।
তার হাতে চায়ের কাপ। সে গ্রামে এসেছে দশদিন হয়ে গেছে। বাড়িটা দেখতে এখন সুন্দর লাগছে। বারবার সোলেমানের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এই উঠানে সে খেলেছে। উঠানে সব সময় একটা শীতল পাটি বিছানো থাকতো। এখানেই বসে সে তার বাবার সাথে দুপুরে খেতে বসতো। শহর থেকে গ্রামই ভালো। আজ সকালে সে পদ্মানদীতে গোছল করেছে। নদীতে গোছল করার মজাই আলাদা। সে ঠিক করেছে দুটা গাইগরু কিনবে। পুকুরে মাছ ছাড়বে। কিছু দেশী মূরগী আর হাঁস পালবে। এগুলো ছাড়া গৃহস্থবাড়ি মানায় না। সে তার মাকে দেখতো, মা সকালে ঘুম থেকে উঠেই উঠান ঝাড়ু দিতো, মূরগীকে খাবার দিতো।
সোলেমানের সকাল থেকেই মন খারাপ।
গতকাল সে তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েকে স্বপ্নে দেখেছে। তার বুকের মধ্যে আনচান করছে। সে একজন সাংসারিক মানুষ। ছেলেমেয়ে স্ত্রী তার জীবন। দশদিন ধরে সে বাড়ির বাইরে। তার ইচ্ছা করেছে ছেলেমেয়েদের কাছে ছুটে যেতে। ঠিক এমন সময় সোলেমান দেখলো তার বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামলো। গাড়ী থেকে তার ছেলেমেয়ে নামলো। স্ত্রী নামলো। ছেলেমেয়ে ছুটে এসে তাদের বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। স্ত্রী দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে পানি। সোলেমান স্ত্রীকে বলল, আরে বোকা কাদছো কেন? বলেই সে তার স্ত্রীর চোখের পানি মুছে দিলো। ছেলেমেয়ে বলল, বাবা এখন থেকে আমরা মাসে দুবার করে গ্রামের বাড়ি আসবো।