
আজকের তাপমাত্রা ছিলো ৩৩ ডিগ্রী।
তবে খুব একটা গরম লাগেনি। সারাদিনই বেশ ঝরঝরে বাতাস ছিলো। সারাদিন মেসে শুয়ে বসে ছিলাম। এক বছর আগের বাসী ম্যাগাজিন পড়েছি। আজ দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। কারন, বুয়া আসেনি। অবশ্য বুয়া আসবে সে কথা গতকালই বলে গিয়েছিলো। আমার ইচ্ছা করেনি বাইরে গিয়ে খেয়ে আসি। আলসেমিতে পেয়েছে। মাঝে মাঝে আলসেমিতে পায়। তখন এক গ্লাস পানিও ঢেলে খেতে ইচ্ছা করে না। মেসের কোনো সদস্য এখন নেই। সবাই কাজে গিয়েছে। কেউ থাকলে বলতাম এক গ্লাস পানি দাও। নিশ্চয়ই দিতো। পানির জন্য মুসলমানরা মানা করে না। কেউ যদি মানা করে তাহলে রোজ হাশরের ময়দানে যখন গলা শুকিয়ে যাবে তখন কেউ এক গ্লাস পানি দেবে না। এখন সময় বিকাল সাড়ে পাঁচটা। অনেক ক্ষুধা লেগেছে। এখন বাইরে যেতেই হবে।
চুল আচড়ে, জিন্স প্যান্ট আর একটা লাল গেঞ্জি পড়ে পথে নামলাম।
পায়ে সাদা কেডস। নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার চেহারা ছবি ভালো। অনায়াসে বাংলা সিনেমার নায়ক হতে পারতাম। আসলে অনেক প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলাম। কিন্তু কিচ্ছু হলো না। ব্যাড লাক। ইচ্ছা করলেই আমি গোর্কির মতো লেখা লিখতে পারি। লন্ডভন্ড করে দিতে পারি বিশ্বসংসার। ডায়নামাইট দিয়ে পুরো ঢাকা শহর উড়িয়ে দিতে পারি। আমি যদি চাই শালা সূর্যটাকেও পায়ের নিচে রাখতে পারি। যাইহোক, বাইরে বের হয়ে মনটা খুশিতে ভরে গেলো। সুন্দর ঠান্ডা বাতাস বইছে। এখন ভর সন্ধ্যা। দেশ গ্রামের মানুষেরা বলতো- ভর সন্ধ্যায় ঘর থেকে বের হতে হয় না। এমনকি সন্ধ্যায় ঘরের দরজা জানালা পর্যন্ত লাগিয়ে রাখতে হয়। নইলে শয়তান ঘরে ঢুকে পড়ে। শয়তান বা ফেরেশতা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। শহরের মানুষ আসলে কোনো নিয়ম কানুন মানে না। রাস্তা ভরতি মানুষ। সবার চোখে মুখে ব্যস্ততা। ফুটপাত দিয়ে আরামে হাঁটা যাচ্ছে না। চিপা ফুটপাত।
ক্ষুধা লেগেছে। এখন খেতে হবে। যদিও পকেটে টাকা নেই।
টাকা নেই সেটা কোনো বড় সমস্যা না বুদ্ধিমান মানুষদের জন্য। এই এলাকার সবচেয়ে ভালো রেস্টুরেন্টের নাম 'ঢাকা হোটেল'। মোটামোটি এদের খাবারের মান ভালো। বয়কে বললাম, রুটি দাও। কাবাব দাও, হালিম দাও। বয় বলল, সাথে কোক দিবো স্যার? আমি বললাম, দাও। বয় চলে যাচ্ছিলো। তাকে আবার ডেকে বললাম, তুমি এক কাজ করো কাচ্চি দাও। বয় বলল, ডবল না সিঙ্গেল? আমি বললাম, তোমার যেটা ইচ্ছা নিয়ে আসো। আমার কোনো সমস্যা নেই। বয় চলে যাচ্ছিলো- আমি বললাম, এই তোমার বাড়ি কি সিলেট? সিলেটের হবিগঞ্জ? বয় বলল, জী। আপনি কিভাবে জানলেন? আমি অনেক কিছুই জানি। তোমার নামও জানি। বলবো তোমার নাম? বয় বলল, বলেন তো। আমি বললাম, তোমার নাম রুস্তম। রুস্তম অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আমাকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পূর্ন কেউ ভাবছে। আসলে এটা অতি সাধারন একটা টেকনিক।
ঢাকা হোটেল থেকে বের হলাম।
এখন সব কিছু আগের চেয়ে বেশি ভালো লাগছে। কারন পেট ভরা থাকলে দুনিয়াতে সব কিছুই ভালো লাগে। কোথায় যাবো সেটাই ভাবছি। এমন সময় এক ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইলো। সে কোন টাকা চায়নি। বলল, একটা রুটি কিনে দিন। ঢাকা শহরে অনেক রকমের ভিক্ষুক আছে। কেউ টাকা চায়। কেউ রুটি কলা চায়। কেউ চিকিৎসার জন্য সাহায্য চায়। আমি ভিক্ষুককে বললাম, আমার পকেটে কোনো টাকা নেই। থাকলে অবশ্যই দিতাম। আচ্ছা, তুমি সিগারেট খাও? ভিক্ষুক হ্যাঁ বলল। আমি বললাম, দেখো অবস্থা ভর পেট খেয়েছি। কিন্তু একটা সিগারেট ধরাতে পারি নাই। সিগারেটের জন্য প্রান যায় যায় অবস্থা। ভিক্ষুক পাঁচটা বেনসন সিগারেট এনে দিলো। একটা ধরালাম। তারপর প্যাকেট পকেটে যত্ন করে রেখে দিলাম। ভিক্ষুক বলল, আমি আপনাকে চিনি সাহেব। একবার আপনি আমাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। আমি বললাম, তুমি ভুল করছো। সেটা আমি না। হয়তো অন্য কেই। ভিক্ষুক আমার কথা মানতে নারাজ। বললাম, আসলে আমি কাউকে কিছু দিলে মনে রাখি না। ভালো থেকো তুমি।
বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাড়ালাম।
এক মেয়ে সিএনজি খুজছে। ফুটপাতে তার মা অথবা দাদী কাতরাচ্ছেন। কোনো সিএনজি চালক পান্থপথ স্কয়ার হাসপাতাল যাবে না। আমি ধমক দিয়ে এক সিএনজি ওলাকে থামালাম। মেয়েটাকে এবং তার সাথে থাকা রোগীকে সিএনজিতে তুলে দিলাম। মেয়েটা বলল, ধন্যবাদ। সহজ সরল সুন্দর একটা মেয়ে। তখন আমার মনে হলো- এই অসহায় মেয়েটাকে আমার আরো সাহায্য করা দরকার। আমিও সিএনজিতে উঠে বসলাম। মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, হাসপাতালে গিয়ে আপনি একা সামলাতে পারবেন না। আপনি একা রোগী নিয়ে বেকায়দায় পড়বেন। কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। সাথে একজন পুরুষ মানুষ থাকা দরকার। মেয়েটা বলল রাইট। মেয়েটার দাঁত গুলো সুন্দর। সাদা এবং দাঁতের সেটিং সুন্দর। সিএনজি চলছে তুফানের মতো। রাস্তায় সিগনাল পড়লেই আমি সিএনজি থেকে নেমে ট্রাফিককে অনুরোধ করতেই ট্রাফিক আমাদের ছেড়ে দিলো। মেয়েটা সম্ভবত আমার প্রতিভায় মুগ্ধ।
রেস্টুরেন্টের নাম মৌবোন। রাত বারোটা।
আমি আর মেয়েটি পাশাপাশি বসে আছি। মেয়েটা বলল, আজ আপনি না থাকলে আমার দাদীকে হাসপাতালে ভরতি করাতে পারতাম না। আমি বললাম, থাক বাদ দিন সেসব কথা। এখন দাদী ভালো আছেন। তাকে সেলাইন দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। এটাই বড় কথা। মেয়েটা বলল, আপনি যেভাবে দৌড়ে দৌড়ে সিট ব্যবস্থা করলেন। ডাক্তার ডেকে আনলেন। আয়াদের ম্যানেজ করলেন- সেগুলো আমি কখনও পারতাম না। আপনি আমার জন্য আজ ফেরেশতা হয়ে এসেছেন। আপনার মতো মানুষ এ যুগে আছে ভাবতেই অবাক লাগে। আমি বললাম, প্লীজ এরকম কথা বাদ দিন। আপনি কিছু খেয়ে নিন। নিশ্চয়ই আপনার অনেক ক্ষুধা লেগেছে। মেয়েটা বলল, হ্যাঁ আমার ক্ষুধা পেয়েছে বেশ। আমি বললাম, আপনি খান। আমি কিছু খাবো না। সন্ধ্যায় আমি আজ অনেক খেয়েছি। মেয়েটা বলল, আমি একাএকা খেতে পারি না। নিজেকে এতিম এতিম লাগে। বাধ্য হয়ে আমাকে মেয়েটার সাথে খেতে বসতে হলো। মেয়েটা কি সুন্দর করে লেবু চিপড়ে রস বের করছে। এর আগে কোনো মেয়ে কি এত সুন্দর করে ভাত খাওয়ার সময় লেবু চিপড়ে রস বের করেছে? মনে হচ্ছে মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।
আমি আর মেয়েটি হাসপাতালের বারান্দায় বসে গল্প করছি।
আকাশে বিজলি চমকাচ্ছে। মেঘ সমানে গর্জন করছে। রাত এখন দুটা। অবশ্যই মধ্যরাত। মেয়েটি হঠাত বললো, সেই সন্ধ্যা থেকে আপনি আর আমি একসাথে আছি। অথচ আপনার নামটাই জানা হলো না। আমি বললাম, আমার নাম শাহেদ। শাহেদ জামাল। মেয়েটি বলল, আমার নাম নীলা। শুধু নীলা। আগে পড়ে আর কিছু নেই। আজকের গল্পটি মোটামোটি এখানেই শেষ। ডাক্তার বলেছেন, সকালে দাদীকে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। তেমন কোনো বড় সমস্যা নেই। নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছিলো। নীলার মা নেই। নীলা যখন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলো সে বছর তিনি ক্যান্সারে মারা যান। নীলা বর্তমানে লালমাটিয়া কলেজে মাস্টার্স করছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। তার বাবা গেছেন চিটাগাং। প্রেম এভাবেই হয়। বলে কয়ে হয় না। এভাবেই হয়ে যায়। নীলার সাথে আমার প্রেম হয়ে গেলো। নীলা খুবই ভালো একটা মেয়ে। অন্য মেয়েদের মতো নীলাকে খুব সাজতে হয় না। শুধু একটু চোখে কাজল দিলেই নীলাকে একদম দেবী সতস্বতীর মতোন লাগে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




