somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

রাজীব নুর
আমার নাম- রাজীব নূর খান। ভালো লাগে পড়তে- লিখতে আর বুদ্ধিমান লোকদের সাথে আড্ডা দিতে। কোনো কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই। নিজের দেশটাকে অত্যাধিক ভালোবাসি। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষদের শ্রদ্ধা করি।

জীবনের গল্প- ৭৫

১৬ ই মার্চ, ২০২৩ দুপুর ২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবিঃ আমার তোলা।

ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি।
পকেটে কোনো টাকা নেই। তিন মাস আগে হঠাত চাকরী চলে গেল। অফিসে আমি প্রচুর পরিশ্রম করতাম। অফিসের কাজে লোকাল বাসে দৌড়ে দৌড়ে উঠতাম। বাসে কোনো দিনই সিট পেতাম না। বানরের মতন ঝুলে থাকতাম। রোদ বৃষ্টির মধ্যে এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানীতে ছুটে যেতাম। দুপুরের খাবার খেতাম- বিকেলে। প্রতিদিন একই অবস্থা হতো। চাকরীটা চলে যাওয়ার পর মনে হলো- কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিল। জানি না সাঁতার, নেই কোনো নৌকা।

পরিচিত অপরিচিত সবার কাছে কাজ চাইলাম, কেউ একটা চাকরী দিল না।
অভাবে অভাবে অনেকটা পাগলের মতন হয়ে গেলাম। ঘরে যা বিক্রি করার মতন ছিল সব বিক্রি করে দিয়েছি। মনে মনে ভেবে রাখলাম- ভাল একটা চাকরী পেলে আবার সব কিনব। কাছের পরিচিতরা সব জেনেও কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো না। বউ অসুস্থ হয়ে পড়লো, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারলাম না। ছোট বাচ্চাটা চোখের সামনে না খেয়ে থাকে এই দৃশ্যও দেখতে হচ্ছে।

আমার মা-বাবা, ভাই-বোন এবং ধনী আত্মীয় স্বজন সবাই'ই আছে।
শ্বশুর বাড়ির অবস্থাও খারাপ না। বউ কঠিন গলায় বলেছে, খবরদার কখনও আমার বাপ- ভাইয়ের কাছে হাত পাতবে না। না খেয়ে মরে গেলেও না। আমি আমার বাপ ভাইয়ের কাছে ছোট হতে পারব না। এই অপমান আর কষ্ট তুমি আমাকে দিও না। বউ এর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি যাইনি শ্বশুর বাড়ি। চাকরী চলে যাবার পর অনেকের কাছেই হাত পেতেছি কিন্তু শ্বশুর বাড়ি যাইনি। তাদের কে আমার অবস্থার কথা কিছুই জানাইনি। চাকরীর জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। এক বড় কোম্পানিতে গেলাম চাকরীর জন্য। এমডিকে বললাম, বউ অসুস্থ, ছোট বাচ্চাটাকে ঠিকভাবে খাবার দিতে পারি না। অন্তত পক্ষে একটা পিয়নের কাজ হলেও দেন। এমডি আমার চোখের পানি দেখলেন তবুও চাকরীটা দিলেন না। সব কোম্পানীর এমডি আর চেয়ারম্যান একই কাজ করলেন। আর বেশ কয়েকজন তো আমার সাথে কথা'ই বললেন না। তাদের কাছে একটা চাকরী কোনো ব্যাপারই না। একটা চাকরী পাওয়া আমার জন্য অনেক দরকার। একটা চাকরী পেলে বউ বাচ্চা নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারব। একজন বললেন, মামা চাচা ছাড়া এই সমাজে চাকরী পাওয়া যাবে না। যতই যোগ্যতা থাক।

আমার তিন বছরের বাচ্চাটাকে নিয়ে যখন রাস্তায় বের হই, বাচ্চাটা রাস্তার পাশের দোকানে ঝুলে থাকা চিপস দেখলেই খেতে চায়, আইসক্রীম কিনতে চায় বিস্কুট কিনতে চায়- কিন্তু আমি এমনই একজন ব্যর্থ বাবা মেয়েটার সামান্য ইচ্ছাও পূরন করতে পারি না। একবার, আমার বাসার কাছে মসজিদের সামনে একটা ফলের দোকান আছে, সেই দোকানে আঙ্গুর দেখে মেয়েটা খেতে চাইল। খুব জিদ করল- কিন্তু আমি কিনে দিতে পারলাম না। নাই চাকরী। পকেটে নাই টাকা। পরে রেগে গিয়ে আমি মেয়েকে একটা থাপ্পড় দিলাম। মেয়েটা বাসায় ফিরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। সারারাত কেঁদেছি। কি কষ্ট...কি কষ্ট।

আমার মেয়েটা ওর মার ওড়না দিয়ে খুব সুন্দর করে প্যাচিয়ে শাড়ি পরে। আবার একটা ঘুমটাও দেয়। আমার কাছে এসে বলে- বাবা দেখ আমি কি সুন্দর সেজেছি। সেদিন মনে মনে ভাবলাম, মেয়েটা শাড়ি পড়তে এত পছন্দ করে, ওকে একটা বাচ্চাদের শাড়ি কিনে দেব। একদিন গুলশানে দেখলাম এক লোক হাতে নিয়ে ছোট বাচ্চাদের শাড়ি বিক্রি করছে। তখন আমার পকেটে আশি টাকা ছিল। ভাবলাম আশি টাকা দিয়েই শাড়ি কিনব। হেঁটে বাসায় ফিরব। বিক্রেতার কাছ থেকে অনেক সময় নিয়ে লাল রঙের একটা শাড়ি নিলাম। শাড়িটা খুব সুন্দর। মনের চোখ দিয়ে একবার ভেবে নিলাম আমার মেয়েটাকে কেমন লাগবে! বিক্রেতা দাম বলল, ২২০ টাকা। পকেটে আছে মাত্র ৮০ টাকা। মেয়েটার জন্য শাড়িটা আর কেনা হলো না। দুঃখ-কষ্টে যেন কলিজাটা ছিরে গেল। একবার ইচ্ছা করলো- বিক্রেতার কাছ থেকে শাড়িটা নিয়ে এক দৌড় দেই। শাড়িটা পেলে আমার মেয়েটা অনেক খুশি হবে। তাহলে আর ওর মার ওড়না প্যাচিয়ে কষ্ট করে পড়তে হবে না।

দরিদ্র লোকদের সব সময় কঠিন অসুখ হয়।
আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লাখ লাখ টাকা লাগবে। কিন্তু আমার কাছে কয়েক 'শ টাকাও নেই। এই জন্যই মাঝে মাঝে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। যখন চাকরী ছিল, তখন অন্তত তিনবেলা ডাল-ভাত খেতে পারতাম। রাতে খাওয়ার পরে আয়েশ করে একটা গোল্ডলিফ সিগারেট ধরাতাম। প্রতিমাসে পুরান বইয়ের দোকান থেকে ৫০০ টাকার বই কিনতাম। সারা মাস সেই বই পড়তাম। মনে হতো, জীবনটা মন্দ নয়। আমার বিলাসিতা বলতে দু'টা জিনিস। বই আর চা-সিগারেট। চাকরী চলে যাওয়ার পর এখন খুব ইচ্ছা করলেও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা-সিগারেটও খেতে পারি না। তবে দুই একটা চায়ের দোকান আমাকে বাকিতে চা-সিগারেট দেয়।

আমার আব্বার কাছে গেলাম।
আব্বাকে বললাম, সংসারের এই পরিস্থিতি। আব্বা খুব মন দিয়ে সব শুনে বলল- বিয়ের আগে কেন চিন্তা করো নাই, এখন আসছো আমার কাছে সাহায্য চাইতে। অনেক রাগারাগি করে আব্বা আমার হাতে ১০০০ টাকা দিল। মনে মনে ভাবলাম, আব্বার'ই বা কি দোষ- সে তিন-চারটা বিয়ে করেছে, অনেক গুলো ছেলে মেয়ে। সে আর কি-ই বা করতে পারে আমার জন্য। কিন্তু এক সময় আব্বার অনেক টাকা পয়সা ছিল। চাইলেই পেতাম। কোনো দিন মানা করত না।

আমার ভাইয়েরা ভাল চাকরী করে। তাদের অনেক টাকা। এক ভাই তো ছুটি কাটাতে মালোয়েশিয়া যায় বউ বাচ্চা নিয়ে। অন্য ভাই যায় কক্সবাজার। বড় ভাইয়ের বাসায় গেলাম। ভাই এর সাথে দেখা হলো না। ভাই নাকি অফিসের কাজে নেপাল গিয়েছে। ভাবী অনেক খাতির যত্ন করলেন। বাধ্য হয়ে ভাবীকে সব বললাম। সব শুনে ভাবী অনেক কষ্ট পেলেন। বড় ভাইয়ের পুরান জামা কাপড় আমাকে দিলেন। জুতো দিলেন দুই জোড়া। আমার স্ত্রীর জন্য তিনটা ছেঁড়া শাড়ি দিলেন। হাতে সতের 'শ টাকা খুঁজে দিলেন। ভাবীর এই উদারতা দেখে আমার চোখ ভিজে উঠলো। ইচ্ছা করলো বাবু বাজার ব্রিজের উপর উঠে নিচে একটা লাফ দেই।

মা'র কাছে গেলাম।
মা আমার কোনো কথাই শুনতে চাইল না। বলল, তোমার অন্য ভাইরা তো ভাল আছে, তোমার এই অবস্থা কেন? তোমার এই অবস্থার জন্য দায়ী তোমার বউ। বউ কে তালাক দিয়ে আসো। তারপর যা পারি- তোমার জন্য করবো। আমি বললাম, মা তুমি এই সব কি বলছো? ও খুবই ভাল একটা মেয়ে। মা আমার সাথে সৎমার মতন আচরন করল। সেদিন মা'র কাছ থেকে অনেক কষ্ট পেয়ে বাসায় ফিরলাম।

ছোটবেলা থেকেই আমি খুব আশাবাদী মানূষ। বড় বড় স্বপ্ন দেখতে আমি একটুও ভয় পাই না। আমি জানি, আমি একজন সৎ মানুষ। এবং অবশ্যই মেধাবী। কেউ একজন হাত বাড়ালেই আমি তর তর করে উপরে উঠে যেতে পারব। আমার বিশ্বাস করতে ভাল লাগে- সু সুময় আসবে। আসবেই।

আমার ভাবতে ভাল লাগে- ভাল একটা চাকরী পাব, ছোট বাচ্চাটাকে অনেক গুলো দামী শাড়ি কিনে দেব, খেলনা কিনে দেব। ভাল একটা স্কুলে ভরতি করে দিব। দোকানে নিয়ে গিয়ে- দোকানের সব চিপস কিনে দেব। স্ত্রীকে সঠিক চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলব। শীতের মৌসুমে স্ত্রীর আর বাচ্চাকে নিয়ে বেড়াতে যাব নীলগিরি পাহাড়ে। স্ত্রীর যদি পাহাড় ভাল না লাগে তাহলে ওকে নিয়ে যাব কক্সবাজার। আমরা তিন জন সমুদ্রের পাড়ে হাঁটব। বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আমাদের পা ভিজিয়ে দেব। আমার মেয়েটা ভয় পেয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরবে। আমার বউ শক্ত করে ধরে থাকবে আমার হাত। যেন সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এসে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে।

চাকরী টা পাওয়ার পর নিজের ঘর এবং ঘরের মানুষদের দায়িত্ব পালনের পর সমাজে পতিত মানুষদের টেনে তুলব। রাস্তার পাশে শুয়ে-বসে থাকা দরিদ্র বাচ্চাদের কোলে তুলে নিয়ে শাড়ি কিনে দেব, দোকানে নিয়ে অনেক চিপস, আইসক্রীম, বিস্কুট আর ফলের দোকান থেকে আঙ্গুর কিনে দেব। মাকে হজ্বে পাঠাবো। ভাবীকে অনেক গুলো নতুন শাড়ি কিনে দেব, আব্বাকে অনেক টাকা দেব, বিপদে-আপদে যে সব কাছের মানুষরা আমাকে সাহায্য না করে তাড়িয়ে দিয়েছে- আমি নিজে থেকে তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব। আমার যা দায়িত্ব, আমি তার থেকে অনেক বেশি করবো। অনেক বেশি করতে চাই।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২৩ দুপুর ২:০৮
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×