সময়টা তখন ১৯৪৭ সাল।
দেশভাগের ফলে আমাদের বিক্রমপুরের মানুষদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। আবার কেউ কেউ রাতারাতি জমি ও বাড়ির দখলের খেলায় মেতেছিলো। দেশভাগের হাহাকার এখনও বহু মানুষের বুকে ঘা হয়ে রয়ে গেছে। দেশ ভাগের এক বছর পর আমাদের গ্রামে জন্ম হয়-মালা' নামের একটা মেয়ের। মালার বাবার নাম মিজু বেপারি। তিনি একজন কৃষক। তার স্ত্রীও স্বামীর সাথে জমিতে কাজ করে। তাদের কোনো অভাব নেই। নিজের পুকুর আছে। পুকুরে মাছ আছে। জমিতে যে পরিমান ধান হয়- নিজেদের জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করে দেন। বাড়ির উঠানে হাঁস মূরগী সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে। গাই গরু আছে। গরুর না মতি। সে প্রতিদিন দুইবেলা দুধ দেয়। মিজু বেপারির দুঃখ তার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তার এত টাকা পয়সা দিয়ে কি হবে? হাকিম কবিরাজের ওষুধ খেয়ে মিজু বেপারির স্ত্রী গর্ববতী হয়। জগতে অনেক আচানক ঘটনা ঘটে। ইহা সত্য।
সেই সময় বাচ্চাকাচ্চা বাসাতেই হতো দাইয়ের হাতে।
একদিন আকাশ ভেঙ্গে জোছনা নেমেছে। মিজু বেপারি উঠানে হাঁটাহাঁটি করছেন। তাকে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে। হিরুর মাকে ডেকে আনা হয়েছে। হিরুর মা খুব ভালো দাই। তার হাতে যাদু আছে। উঠানে দুটা কুকুর সমানে ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। জোছনা রাতে কুকুরদের মাথা আউলায়ে যায়। মিজু বেপারি কুকুরদের বলল, চুপ কর। চুপ কর। এমন সময় দাই হিরুর মা নবজাতকে এনে মিজু বেপারির কোলে দেয়। জোছনার আলোতে নবজাতককে দেখে মনে হলো- যেন কোনো দেবশিশু। মিজু বেপারি খুশিতে অনেক গুলো টাকা বের করে দাইয়ের হাতে দেয়। মিজু বেপারির খুশিতে চোখে পানি চলে এলো। সে বলল, আমার কন্যা ভাগ্যবতী হবে। সে এই দেশের জন্য অবশ্যই ভালো কিছু করবে। বাপের নাম ও মান রাখবে। মিজু বেপারি তার কন্যাকে কোলে নিয়ে আযান দিলেন। কন্যার জন্মের খুশিতে মিজু বেপারি তিন মন মিষ্টি সারা গ্রামের মানুষদের খাইয়ে দিলেন। আমার দাদার বাড়িতে দশ কেজি মিষ্টি পাঠিয়েছিলো মিজু বেপারি। বিক্রমপুর অঞ্চলের মিষ্টির বেশ নামডাক আছে।
নবজাতকের নাম রাখা হলো- মালা।
মালা নামটা মিজু বেপারির মায়ের নাম। আদর ভালোবাসায় মালা বড় হতে থাকলো। একদিন তাকে স্কুলে ভরতি করিয়ে দেওয়া হলো। লেখাপড়ায় মালা খুবই ভালো। দেখতে দেখতে একদিন মালা কলেজে ভরতি হয়ে গেলো। কলেজে ভরতি হওয়ার পর থেকেই নানান সমস্যা দেখা দিলো। মালাদের বাড়ির আশেপাশে অনেক ছেলেকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। বাড়িতে বেনামে চিঠি আসতে লাগলো। এদিকে মালার মা অনেকদিন আগেই মারা যায়। তাঁরা বাবা আরেকটা বিয়ে করে। তবে সৎ মায়ের সাথে মালার সম্পর্ক ভালো। মালার বাবা মালাকেই গালমন্দ করে। উনি বলেন, মালা যদি ভালো হতো- তাহলে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারতো না। বাড়িতে কেন প্রতিদিন বেনামে আজেবাজে চিঠি আসবে? এটা ভদ্র লোকের বাড়ি। তিনি কঠিন করে বললেন, মালার আর লেখাপড়ার দরকার নেই। তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। ব্যস। ঝামেলা শেষ। কিন্তু মালা লেখাপড়া করতে চায়।
মালার বিয়ে হয়ে গেলো।
তাকে জোর করেই বিয়ে দেওয়া হলো। মালার স্বামীর নাম রতন। রতন ধান কেনাবেচার ব্যবসা করে। ইনকাম মন্দ না। বিয়ের পর মালা তার স্বামীকে বলল, আমি লেখাপড়া করতে চাই। তার স্বামী বলল, ঠিক আছে। আগামী বছরে ভরতি হয়ে যেও। সেই আগামী বছর আর আসে না মালার জীবনে। এদিকে রতন মালাকে প্রায়ই মারে। অতি সামান্য কারনে মারে। ডালে লবন কম ক্যান, দে মাইর। আমার জামা আমাকে না জিজ্ঞেস করে ধুয়ে দিলে কেন, দে মাইর। মারের কোনো উছিলা লাগে না। একদিন মালা বাধ্য হয়ে তার বাবা মাকে বলল। বাবা মা বললেন, সংসারে স্বামী স্ত্রীর মাঝে এরকম হয়েই থাকে। এটা সিরিয়াস কিছু না। একদিন মালা সিদ্ধান্ত নিলো এভাবে আমি প্রতিদিন স্বামীর হাতে মাইর খেতে পারি না। মালা একদিন স্বামীকে ইচ্ছে মতো মারলো। মার খেয়ে রতন কে হাসপাতালে ভরতি হতে হলো। এরপর মালা ও রতনের আর সংসার করা হয়ে উঠেনি। রতন তাকে তালাক দেয়। এই ঘটনা শুনে মিজু বেপারি তার মেয়ের উপর খুবই রেগে গেলো। বলল, আমার বাড়িতে তোমার জন্য কোনো জায়গা নেই।
মালা এখন যাবে কোথায়?
ঠিক এসময় দেশে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। আপাতত মালার অস্থায়ী ঠিকানা হলো- আলামিন বাজারের প্রাইমারী স্কুলের হেড মাস্টার রজনী বাবুর বাড়িতে। রজনী বাবুর বয়স ৭৬। তার ছেলেমেয়ে আর স্ত্রী কলকাতাতে, সেই দেশভাগের আগই চলে গেছে। কিন্তু তিনি এদেশ ছেড়ে যাননি। তিনি মালাকে তার বাড়িতে জায়গা দিলেন। এবং বললেন, আজ থেকে তুই আমার মেয়ে। মালা বলল, আমি যুদ্ধ করতে চাই। আপনি সব ব্যবস্থা করে দেন। রজনী মাস্টার বললেন, তুই মেয়ে মানুষ। বন্ধুক হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতে পারবি? মালা বলল খুব পারবো। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা রজনী মাস্টারের বাড়িতে আসে। মালা তাদের রান্না করে খাওয়ায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বলে, তোমাদের সাথে আমাকে নিয়ে চলো। মুক্তিযোদ্ধারা বলে, এই যে তুমি আমাদের রান্না করে খাওয়াচ্ছো। তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। একদিন রজনী মাস্টারের বাড়িতে সোলেমান নামে এক রাজাকার পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আসে। রজনী মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এবং মালাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মাল্লার আর কোনো খোজ খবর পাওয়া যায়নি। ঘটনাটি আমি আমার দাদার কাছ থেকে শুনেছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২৩ বিকাল ৪:৫৩