
তারেক কি কমিউনিস্ট ছিলো?
নইলে সে কমিউনিস্টদের মতো মার্কামারা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে কেন? সমস্ত কমিউনিস্টদের পোশাক দেখেই চেনা যায়। আজকাল অবশ্য কমিউনিস্ট খুজে পাওয়া মুশকিল। কমিউনিস্টরা বুঝে গেছে এভাবে হ্য় না, হবে না। আমি এতটুকু বুঝি, কমিউনিস্টদের বেশির ভাগ ধারনাই লজিক্যাল নয়। গৌরব করার মতো কমিউনিস্টদের কিছু নেই। আমার কাছে তারেকের পরিচয় একটাই, সে আমার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু, কাছের বন্ধু, আপন বন্ধু। তারেক বলতো পৃথিবীতে যত মানুষ আছে, সকলের খাবারের ব্যবস্থা আল্লাহ করে রেখেছেন। আমি বললাম, তাহলে দরিদ্র দেশ গুলোতে এত অভাব কেন? মানুষ না খেয়ে থাকে কেন? তারেক সাথে সাথে বলল, এই অভাব মানুষের সৃষ্টি। তাঁরা আল্লাহর উপরে মাতব্বরি করছে। এর ফল ভালো হবে না।
নির্জন সন্ধ্যা। পদ্মার উপর গভীর গাঢ় কুয়াশা।
নদীর ধার দিয়ে গরুর গাড়ি চলছে, এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা। রাখাল গরুর পাল নিয়ে চলেছে। কুয়াশার কারনে বড় বড় গাছ গুলোকে ভূত বলে মনে হয়। থোকায় থোকায় জোনাকি পোকা জ্বলছে আর নিবছে কুয়াশা ভেদ করে। কুয়াশা না থাকলে বিশাল ধানক্ষেত চোখে পড়তো। উত্তর দিক থেকে ভয়ংকর ঠান্ডা বাতাস আসছে। খাল থেকে পঁচা গন্ধ আসছে। পাটপচা গন্ধ, সেই সাথে মুলি বাঁশ পঁচছে। এই দেবযানী খালেই আমার বন্ধু তারেককে মেরে ফেলে রাখা হয়েছিল। তিন দিন পর তার পঁচা গলা লাশ পাওয়া দেখা গেলো। বালাসুর থেকে কামারগাও বাজার পযর্ন্ত দেবযানী খাল ছিলো। বর্ষায় টইটুম্বুর হয়ে থাকতো দেবযানী। আমি আর তারেক এই দেবযানী খালে মাছ ধরতাম। বরশি ফেলে আমি আর তারেক কলাপাতা মাথায় ধরে থাকতাম বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। একদিন তারেক একটা বেশ বড় কালিবাউস ধরে ফেলল। প্রাইমারী স্কুলের অবসর প্রাপ্ত নিতাই স্যার কালিবাউস উপহার পেয়ে ভীষন খুশি হলো।
আমার বন্ধুর নাম তারেক। তারেক মাহমুদ।
আমরা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতাম। আমাদের রুম নাম্বার ছিলো- ২২২। তারেক গভীর রাতে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতো। বলতো রাতের ঢাকার চরিত্র আলাদা। তারেকের পাল্লায় পড়ে এই শহরের অলি গলি ঘুরে বেড়াতে হতো। মধ্যে রাতে নীলক্ষেতের ফালতু তেহারি খেতো হাসিমুখে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলতো- নিজেকে মিশরের সম্রাট বলে মনে হয়। তারেক খুব ভালো ক্রিকেট খেলতো। জেলা পর্যায়ে খেলেছে। এক বছর আবহানীর হয়ে খেলেছিলো। জীবন তার কাছে ক্রিকেট খেলার মতোই উপভোগ্য ও উত্তেজনায় ভরা। তারেক ফুর্তিবাজ ছিলো। মারামারি করতো, আবার কেউ মারা গেলে নিজের হাতেই করব খুড়তো। তার কর্মকান্ড বিচিত্র ও বহুমুখী। তার রাগ যেমন বেশি, ভালোবাসাও বেশি। যাকেই পছন্দ করতো তার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারতো। আবার যার উপর রাগ হতো, তাকে জুতো দিয়ে মারতে দ্বিধা করতো না।
এই তারেক ছিল আমার বন্ধ। খুব ভালো বন্ধু।
অথচ সে ক্রিকেটে চান্স পেলো না। তারেক সন্ধ্যা নামে এক মেয়েকে ভালোবাসতো। অথচ তীব্র রাগের কারন সন্ধ্যার সাথে তারেকের বিয়ে হয়নি। সন্ধ্যা বিয়ে করে তাঁরা স্বামীর সাথে আমেরিকা চলে গেছে। দীর্ঘদিন তারেক আফসোস করে বলেছিলো, 'সন্ধ্যাকে নিয়ে সন্ধ্যা নদীর পাড়ে বসে জোছনা দেখা হলো না'! সবচেয়ে বড় কথা তারেক উগ্র মেজাজের কারনে কোথাও তিন মাসের বেশি চাকরি করতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি দিন (চার মাস) চাকরি করেছিল একটা ব্যাংকে। অবশ্য চাকরি না করলেও তারেকের সমস্যা ছিল না। তার বাপ দাদা অনেক ধনী ছিলো। তারেক খুব দিল দরিয়া মানুষ। একবার আমি রাজশাহীতে গিয়ে বেশ বিপদে পড়েছিলাম। তারেক কে ফোনে জানালাম বিপদের কথা। আধা ঘন্টার মধ্যে তারেক এসে হাজির। সে হেলিকাপ্টারে করে চলে এসেছিলো। কিছু কিছু মানুষের পুরো শরীরটাই কলিজা। তাদের সাহসের অভাব হয় না।
একবার আমি আর তারেক পদ্মা নদীর পাড় দিয়ে হেটে হেটে স্কুলে যাচ্ছিলাম।
এক পাগল হঠাৎ আমাদের তাড়া দিলো। দোষটা তারেকের। পাগল নিরিবিলিতে বসে পায়খানা করছিলো। তারেক পাগলকে একটা ঢিল মারে। পাগল তো রেগেমেগে আমাদের তাড়া করলো। বলল, হারামির বাচ্চারা দাড়া। আমি আর তারেক দৌড়াচ্ছি। আমাদের বইখাতা হাত থেকে পড়ে গেছে। তারেকের চেয়ে দৌড়ে আমি ভালো। স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি সবসময় একটা কাচের প্লেট পুরস্কার পেতাম। সেই কাঁচের প্লেট গুলো এখনও আছে। মা শোকেসে সাজিয়ে রেখেছে। যাইহোক, দ্বিগম্বর পাগল শেষমেশ আমাদের ধরতে পারেনি। আমি আর তারেক দেবযানী খাল পেরিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। পাগল তার এড়িয়ার বাইরে যাবে না। তার সীমানা দেবযানী খাল পর্যন্ত। এই ঘটনা পরবর্তী জীবনে আমাদের বহুবার হাসিয়েছে। তারেকের কারণে অদ্ভুত সব বিপদে পড়তে হতো। আরেকবার কালিবাড়ি শ্মশানে বিরাট বিপদে পড়েছিলাম। সেই গল্প আরেকদিন বলব।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২৩ বিকাল ৩:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


