ওমর আলীর জ্বর এসেছে।
তাই টারজান গিয়েছে বাজার করতে। এর আগেও টারজান বেশ কয়েকবার বাজার করেছে। বাজার করতে তার ভালোই লাগে। ওমর আলী বলেছেন, তার জ্বর ভালো হলে পুষ্প আর তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে ধানমন্ডিতে। সেখানে নাকি অনেক গাছপালা আছে বড় বড় পুকুর আছে। বিশাল বিশাল ধানক্ষেত। আশেপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই। সন্ধ্যার পর সেখানে গেলেই শেয়াল দেখা যায়। এসব এলাকায় লোকজনের চলাফেরা কম।
'আজাদ' পত্রিকাটা হঠাত বন্ধ হয়ে গেল।
ওমর আলী নিয়মিত 'আজাদ' পত্রিকাটা পড়তেন। 'সাধু সাবধান' শিরোনামে সম্পাদকীয় টা পড়ে তিনি বেশ মজা পেয়েছেন। দুঃখজনক ব্যাপার হলো 'সাধু সাবধান'' নামে কলামটি লেখার কারনেই পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। 'আজাদ' মূলত মুসলিমলীগ ভাবধারার পত্রিকা। আজাদ বন্ধ হয়ে যাবার পর ভাসানীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক 'ইত্তেফাক'। ওমর আলী বুঝতে পারেন, এটি কট্টর মুসলিমলীগ বিরোধী পত্রিকা এবং পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী পত্রিকা হবে।
ওমর আলী ঠিক করেছেন, আজ সারা দিন শুয়ে শুয়ে বই পড়বেন।
হাতের কাছে তার চারটি বই আছে। যে কোনো একটি বই তিন আজ পড়বেন। বুকের কাছে বই নিয়ে তিনি ভাবছেন- দেশ ভাগ হলো ধর্মের ভিত্তিতে। একভাগে পড়লো মুসলিমরা ও অন্য ভাগে পড়লো হিন্দু ধর্ম অনুসারীরা। মুসলিম রাজ্যে আবার দুটো ভাগ পশ্চিম আর পূর্ব। পশ্চিম আর পূর্বের প্রজাদের মাঝে সাংস্কৃতি -ঐতিয্যে ও জীবনযাত্রায় আবার ব্যাপক তফাত। দেশভাগ মানুষকে ছিন্নমূল ও যাযাবর করে দিয়েছে। একাধিকবার ঠাঁই বদল করতে হয়েছে মানুষকে।
বাজারের পথ টারজানের চেনা।
তবু সে যতবার বাজারে যায় ভিন্ন পথ দিয়ে যায়। নতুন একটা রাস্তা তার চেনা হয়ে যায়। যেন এই রাস্তাটা আগে ছিল না, এটা তার আবিস্কার। তবে সব রাস্তা কেমন খালি খালি। শুধু মাত্র বাজারে আর বৈশাখী মেলায় কিছু লোকজন দেখা যায়। ওমর আলী তাকে বলেছেন- এই শহরে অনেক লোক বাস করে, প্রায় সাড়ে তিন লাখ। গ্রাম থেকে অনেক ছেলে শুধু মাত্র লেখাপড়া করার জন্য ঢাকা কলেজে পড়তে আসে। তারা হোস্টেলে থাকে। টারজানের খুব ইচ্ছা ঢাকা কলেজে পড়ার। ওমর আলী বলেছেন, খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করলে শুধু ঢাকা কলেজ না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। এই জন্য টারজান খুব মন দিয়ে পড়ছে। যদিও ক্লাশে সে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছাত্র। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে খুব ভালোবাসেন।
পুষ্প টারজানের বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিল-
'অতি ক্ষুদ্র জিনিসটা, বহন করে মানুষটা'। কিন্তু গত দিন ধরে ভেবেও ধাঁধার উত্তরটা খুঁজে বের করতে পারেনি। কি এমন জিনিস যা একটা মানুষকে বহন করতে পারে? অতীত দিনের সৃতি? নাকি উকুন? বাজার শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে পুষ্পের সাথে টারজানের দেখা হয়। পুষ্প'ই প্রথমে দেখে টারজানকে।
প্রশ্ন করলো পুষ্প কি মাছ কিনলে আজ?
ট্যাংরা মাছ।
ট্যাংরা মাছ কি তোমার প্রিয় মাছ?
না, আমার প্রিয় মাছ চিংড়ি। কিন্তু আজ বাজারে চিংড়ি মাছ উঠেনি। তবে, ওমর চাচা গতকাল বলেছিলেন, ট্যাংরা মাছ খেতে ইচ্ছে করছে। চাচীও বললেন, ট্যাংরা মাছের কথা।
পুষ্প বলল- এই মাছ কিভাবে রান্না করে জানো?
টারজান বলল, জানি না। আমি শুধু খেতে জানি।
পুষ্প বলল- এই মাছ আমি না খেলেও রান্নার নিয়ম জানি। প্রথমে মাছ কেটে পরিষ্কার করে ধুয়ে পানি ঝরাতে হবে। চুলায় ফ্রাইপ্যানে তেল দিতে হয়। তেল গরম হলে পেঁয়াজ বাটা, রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, লবণ ও সামান্য পানি দিয়ে ভালো করে কষে নিতে হয়। কষানো হলে তাতে মাছ ও আলু কুচি দিতে হয়। একটু নেড়ে এক কাপ পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। মাছ ও আলু সেদ্ধ হলে ধনেপাতা ও কাঁচা মরিচ দিতে হবে। তারপর গরম ভাতের সঙ্গে গপ-গপ করে খেতে হয়। টারজান অবাক হয়ে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে আছে!
সরলা বিবির কাপড়ের ব্যবসা ইদানিং মন্দা যাচ্ছে।
আসামে তার পিতলের থালা বাসন আরও অনেক নিত্য ব্যবহার্য জিনিস ভালোই চলছিলো। সেখান থেকে চলে আসতে তারা বাধ্য হলেন। বাকিটা জীবন এখানেই থাকতে হবে। আর কি কখনও আসাম যেতে পারবেন? গতমাসে কলতাবাজার এলাকায় তিন কাঠা জমি কিনেছেন। ওমর আলী সংসারী মানুষ না। যা করার তাকেই করতে হবে। এ ব্যাপারটা তিনি ওমর আলীকে বিয়ে করার তিন মাস পর বুঝতে পারেন। কিন্তু তিনি ওমর আলীকে খুব ভালোবাসেন। সেদিন কোথা যেন টারজান নামের একটা ছেলেকে ধরে এনেছে। ছেলেটাকে তিন-রাত পড়াচ্ছেন। নিজের মেয়ে পুষ্প যে পাড়া বেড়ানি হয়েছে সেদিকে লক্ষ নেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের পেঁয়াজ কেটে দেয়। কুয়া থেকে পানি তুলে দেয়। উঠান ঝাড়ু দিয়ে দেয়। ছোট বাচ্চাদের গোছল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়। সরলা বিবির আফসোস মেয়েটা তার মতো হয়নি। তার বাবার স্বভাব পেয়েছে।
সেদিন ওমর আলী বলছিল- বাংলা ভাষায় নাকি আর কথা বলা যাবে না।
উর্দুতে কথা বলতে হবে। পাকিস্তানের হর্তা-কর্তা নাকি তাই'ই চায়। বিষয়টা সরলা বিবির মোটেও ভালো লাগেনি। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়াটা তার একেবারেই অপছন্দ। এর আগে জোর জবস্তি দেশ ভাগ করা হলো। এখন বলছে উর্দু হবে আসল ভাষা। দেশ ভাগ করা হয়েছে, তিনি চুপ করে ছিলেন। কিন্তু কেউ যদি তার মুখের ভাষা কেড়ে নেয়- তাহলে তিনি চুপ করে বসে থাকবেন না। তার যা আছে তিনি তাই নিয়ে প্রতিবাদ করবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭