
প্রিয় কন্যা আমার-
প্রায় পাচ মাস পরে আজ তোমাকে নিয়ে লিখতে বসেছি। এতদিন কিছু লিখি নাই কারন, এতদিন আমি সামু ব্লগে ব্যানে ছিলাম। অনেকে ভেবেছেন আমি বুঝি রাগ করে সামু ছেড়ে দিয়েছি। রাগ করে ব্লগ ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। ব্যান না করলে এতদিন অনেক লেখা লিখতাম। হ্যা মডারেটর সাহবের উপর কিছুটা রাগ হয়েছে, এটা সত্য। তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য আমাকে ব্যান করেছেন। মডারেটর সাহেব একবার ভাবলেন না, যে মানুষটা প্রতিদিন ব্লগে একটিভ, প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখছে, তাকে কিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যান করে রাখি! কোনো এক বিচিত্র কারনে, উনি চান না আমি সামুতে থাকি। ইহা আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। যাইহোক, আমি মনে মনে অপেক্ষায় ছিলাম কবে আমাকে ব্যান মুক্ত করবে। প্রতিদিন মেইল চেক করি। না সামু থেকে কোনো মেইল আসে না। আজ কি মনে করে সামুতে ঢুকে দেখি আমাকে সব রকম ব্যান থেকে মুক্ত করা হয়েছে। সামুতে দীর্ঘদিন আমাকে ব্যান করে রাখলেও আমি আমার লেখালেখি বন্ধ রাখি নাই। প্রচুর লিখেছি। নিয়মিত লিখেছি। অবশ্য চাঁদগাজীও চান না আমি সামুতে লিখি। তিনি চান সামুতে সময় না দিয়ে, আমি আমার স্ত্রী কন্যাকে সময় দেই। উনি বুদ্ধিমান মানুষ।
প্রিয় কন্যা ফারাজা তাবাসসুম,
গত পাচ মাসে অনেক কিছু ঘটে গেছে। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা ঘটেছে সেটা হলো- তোমাকে স্কুলে ভরতি করিয়ে দিয়েছি। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। স্কুল তোমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি আগ্রহ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছো। এমনিতে তুমি সকাল ১১ টায় ঘুম থেকে উঠো। স্কুলে যাওয়ার জন্য ভোর সাত টায় ঘুম থেকে উঠে যাও। সকাল আট টায় তোমার ক্লাশ শুরু হয়। তোমার মা তোমাকে নিয়ে যায়। তোমাকে টিফিন দেওয়া হয়। তুমি আগ্রহ নিয়ে টিফিন খাও। ক্লাসে ভীষন রকমের মনযোগী। কিন্তু হঠাত তোমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। দেশে শুরু হলো গন্ডগোল। কোটা আন্দোলন নিয়ে সুত্রপাত। টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে চললো, আন্দোলন। তোমার স্কুল বন্ধ। তোমার মন খারাপ তুমি স্কুলে যেতে পারছো না। সারাদিন বাসায় তুমি শুয়ে বসে থেকে যথেষ্ট বিরক্ত। তোমাকে নিয়ে বাইরেও যেতে পারি না। কখন গোলাগুলি হয়। টানা এরকমাস বেশ টেনশনে সময় কেটেছে আমাদের। শুধু আমাদের না, পুরো দেশবাসীর। আমি খুব চেষ্টা করেছি, তুমি যেন বোরিং না হও।
এই আন্দোলনের কয়েকটা ঘটনা তোমাকে বলি-
এক বাবা তার ছোট মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ছাদে গেছে। সেই বাচ্চার গায়ে গুলি লাগে। বাচ্চাটা মারা যায়। আরেক বাচ্চা ব্যলকনিতে ছিলো, তার গায়েও এসে গুলি লাগে। সেই বাচ্চাও মারা যায়। সাঈদ নামে এক ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে মারা যায়। পুলিশ তাকে বুকে গুলি করে। ছেলেটা ভাবতেও পারেনি পুলিশ তাকে গুলি করবে? ধীরে ধীরে কোটা আন্দোলন রুপ নিলো সরকার পতনের আন্দোলনে। এদিকে শেখ হাসিনা কিছুতেই পদত্যাগ করবেন না। ছাত্ররা গেলো ক্ষেপে। পুরো দেশ রণক্ষেত্র। শুরু হয়ে গেলে জ্বালাও পোড়াও। এই সুযোগে ছাত্রদের সাথে যোগ দিলো জামাত, শিবির আর বিএনপি। শুরু হলো ভাংচুর, আগুন দিয়ে থানা পুড়িয়ে দেওয়া। পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলা। এক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলো সারা দেশে। সারা দেশের সাধারণ মানুষ ভয়ে অস্থির। না জানি কি হয়! এদিকে সরকার দিলো ইন্টারনেট বন্ধ করে। সবার সাথে সবার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত সব বন্ধ। রাস্তায় বের হলে আমি নিজেই বুঝতে পারি না- কে ছাত্র, কে শিবির, কে বিএনপি। কে কাকে মারছে কিছুই বুঝতে পারছি না। চারিদিকে নানান রকম গুজব। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বুঝা যাচ্ছে না।
প্রিয় কন্যা ফারাজা-
এই গন্ডোগলের মধ্যে আমি ঘরে চুপ করে বসে থাকিনি। আমি সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। মিরপুর দশ- এ দেখলাম। ছাত্ররা অবস্থান নিয়েছে। আসলে কে ছাত্র, কে জামাত আর কে বিএনপি বুঝতে পারছিলাম না। সবার হাতে লাঠি। সবাই উত্তেজিত। রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে আগুন জ্বলছে। ট্রাফিক বক্স গুলোতে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুলিশ মারাত্মক একশনে গিয়েছে। তারা গুলি করছে, কাদানো গ্যাস ছুড়ছে। গুলি করছে, যাকে সামনে পাচ্ছে সমানে পিটাচ্ছে। মেট্রোরেলে আগুন দেওয়া হলো। অনেক সরকারি অফিসে আগুন দেওয়া হলো। সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। করা হলো লুটপাট। লুটপাট যে কোন দল করলো বুঝতে পারাম না। চারিদিকে ভয়াবহ এক অরাজকতা। তখন পথে নামলো আর্মি। সেনা বাহিনী। আর্মি ছাত্রদের সাপোর্ট শুরু করলো। সেনাবাহিনী দেশের সবার সাপোর্ট পেলো। ছাত্ররা চিৎকার করে বলতে শুরু করলো- 'এই মুহুর্তে দরকার সেনাবাহিনীর সরকার'। এদিকে বহু মানুষ আন্দোলনরত ছাত্রদের পানি দিচ্ছে, খাবার দিচ্ছে। পানি বিলাতে গিয়ে মারা গেলো মুগ্ধ নামের এক ছাত্র। দেশের অনেক সাধারণ জনগন পুলিশের গুলিতে মরলো। এত এত মৃত্যু দেখে দেশের সব মানুষ রেগে গেলো সরকারের উপর। এখন জনগন চায় সরকারের পতন। সহজ হিসাব, জনগন যা চায় তাই হয়। এরকমটা যে হবে শেখ হাসিনা স্বপ্নেও ভাবেন নাই। যে কাজ বিএনপি গত পনের বছরে পারে নাই।
ফারাজা তাবাসসুম খান ফাইহা,
তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা চলে গেলেন, ইন্ডিয়া। আসলে চলে যেতে বাধ্য হলেন। অন্য কোনো উপায় তার ছিলো না। উনি সেদিন পালিয়ে না গেলে জনগন তাকে সেদিনই একদম মেরে ফেলতো। অনেকে গণভবনে খুশিতে লুটপাট করলো। আমি নিজের চোখে দেখলাম- খুশিতে সারা ঢাকা শহরের মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। তারা আনন্দ মিছিল শুরু করলো। সবাই সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। পুরো ঢাকা শহরের সমস্ত মিষ্টির দোকান খালি হয়ে গেলো। সবাই নাচছে। সবার চোখে মুখে আনন্দ। ফারাজা তোমার মাকে দেখলাম, রাস্তায় নেমে পড়লো। সে-ও আনন্দ মিছিলে যোগ দিলো। এর আগে যখন শহীদ মিনারে যখন ছাত্রদের সাথে সাধারণ মানুষ জড়ো হয়েছে। তোমার মা চলে গেলো ছাত্রদের পাশে দাড়াতে। সে শহীদ মিনারে গেলো। বাসায় ফিরেই আমাকে বলল, শেখ হাসিনার পতন অনিবার্য। যাইহোক, আন্দোলন থামলো। শেখ হাসিনা পালালো। কিন্তু এরপরও দেশে শান্তি নেই। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হলো ডাকাতি। কারন, পুলিশরা কেউ ডিউটি করছে না। তখন প্রতিটা এলাকায় রাত জেগে পাহাড়া দিলো তরুন ছেলেমেয়েরা। এদিকে রাস্তায় ট্রাফিক কন্টোল করছে ছাত্ররা। মেট্রোরেলের পিলারে তারা ছবি আকছে। ছবি এঁকে এঁকে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। অবশেষে নোবেল বিজয়ী ইউনূস সাহেব এসে অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিলেন। মিথ্যা বলব না ফারাজা, শেখ হাসিনা পালালো। মানুষের আনন্দ মিছিল দেখতে আমি তোমাকে নিয়ে বের হলাম।
আওয়ামীলীগের লোকজন যেখানে পারলো পালিয়ে গেলো।
ছাত্রলীগের পোলানদের কোনো খোজ খবর নেই। যুবলীগের কোনো খোজ খবর নেই। মন্ত্রী, এমপি, নেতা, পাতি নেতা সবাই পালিয়ে গেলো। এদের মধ্যে অনেকে ধরা পড়লো অতি হাস্যকর ভাবে। যাইহোক, আমি যতটুকু বুঝলাম- এখন দেশের জনগন চায় না হাসিনা বা খালেদা আবার ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু হাসিনার পতনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে বিএনপি। হাসিনার পতনের জন্য গত পনের বছর ধরে তারা নানা রকম চেষ্টা করেছে। এবং বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি এখন আশায় বুক বেধেছে। খালেদা জিয়া ছাড়া পেয়েছেন। কারাগার থেকে বহু লোক ছাড়া পেয়েছে। এখন ইউনুস সাহেব কি করেন সেটা দেখার অপেক্ষায় পুরো দেশবাসী। আজকে লেখা এখানেই শেষ করছি ফারাজা। আবার পরে লিখব। তবে একটা কথা বলি- ছাত্ররা শেষ মুহুর্তে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলো। আমি সেদিন বাসা থেকে বের হয়েছি। রাস্তায় কোনো বাস নেই, গাড়ি নেই, সিএনজি নেই। রাস্তায় বের হয়ে আমি বিরাট বিপদে পড়লাম। বিজয় স্মরনী এসে দেখলাম- সেনাবাহিনী রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। অপর দিকে প্রচন্ড গোলাগুলি হচ্ছে। সেদিন আমি ভেবেছিলাম আজ বুঝি আমার গুলিতে মৃত্যু হবে। আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। তুমি আমার অপেক্ষায় আছো। অবশেষে আমি বাসায় ফিরলাম। হেটে হেটে বিজয় স্মরনী থেকে। টানা আড়াই ঘন্টা হেঁটেছি।
শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগুন দিয়েছে।
লুটপাট করেছে। শেখ মুজিবের সমস্ত ভাস্কর্য ভেঙ্গে দিয়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি ভাস্কর্যের গায়ে মুতে দিয়েছে। এই বিষয় গুলো আমার মোটেই ভাল লাগেনি। দেশের মানুষ এতটা নিচে নামবে সেটা আমি বুঝতে পারি নাই। সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেলাম- ১৫ আগস্ট যারা ৩২ নম্বর গিয়েছে শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা জানাতে তাদের মাইর দেওয়া হয়েছে। তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। চারিদিকে এত এত অমানবিক আচরণ দেখে, আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে। মানুষের এরকম হিংস্র আচরণ দেখে আমার ইচ্ছা করেছে এ দেশ ছেড়ে চলে যাই। দেশের মানুষ আজও সভ্য হতে পারেনি। আমার স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে এই দেশে কেমন করে বেঁচে থাকবো? আমার কন্যা কি পারবে এই দেশে আনন্দ নিয়ে বড় হতে? মানুষের নিষ্ঠুরতা দেখে আমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, চিন্তিত, ভীত।

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২৪ রাত ১১:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



