
রিকশায় উঠে জীবনে একবারই ভালো লেগেছিলো।
অনেক বছর আগে। সেটা আজও ভুলিনি। কোনোদিন ভুলিব না। সেই ঘটনাটা বলা যেতে পারে। একদিন নীলা ফোন করে বলল, বিকেলে শহীদ মিনার আসো। নীলা আমার বন্ধু। হলে থেকে পড়াশোনা করছে। নীলার সাথে আমার সম্পর্কটা প্রেম ভালোবাসার নয়। তবু নীলা ডাকলে মানা করতে পারি না। নীলা হচ্ছে সহজ সরল সুন্দর একটা মেয়ে। মানবিক এবং হৃদয়বান। নীলাকে আমি অনায়াসে যে কোনো কথা বলতে পারি। নীলাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলতো আমি কেমন ছেলে? নীলা কোনো রকম ভনিতা না করে বলেছিলো- তুমি এমন একজন মানুষ যাকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করা যায়। মন খারাপ হলে যার কাধে মাথা রেখে কান্না করা যায়।
একদিন ভরদুপুরে ফোন করে আমায় ডাকলো।
সে ক্লাস করবে না। তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমি দৌড়ে গেলাম নীলার সাথে দেখা করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমাদের একটা প্রিয় জায়গা আছে, আমরা সাধারণত সেখানে বসেই গল্প করি। মাথার উপরে বিশাল গাছ! আমরা বাদাম খাই, আইসক্রিম খাই, ঝালমুড়ি খাই। আর নানান বিষয়ে গল্প করি। বহু দুপুর কাটিয়েছি নীলার সাথে। মঞ্চ নাটক দেখেছি। বহু বার তূরাগ নদীতে নৌকায় করে গোলাপ গ্রাম গিয়েছি। বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে পদ্মপুকুরে চুপচাপ বসে থেকেছি। আর্ট গ্যালারিতে গিয়ে ছবি দেখেছি। পুরান ঢাকাতে যেতাম বিরানি খেতে। আমরা রিকশায় করে সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। রিকশায় উঠলেই নীলা বলতো, তুমি কি চাও আমি রিকশা থেকে পড়ে যাই? আমি বললাম, না। নীলা বলতো, তাহলে আমাকে ধরে রাখছো না কেন?
একদিন ফুলার রোডে গেলাম নীলার সাথে দেখা করতে।
সেদিন কোনো কারণে নীলার মন খারাপ ছিলো। আমরা হাটতে হাটতে শহীদ মিনার পর্যন্ত গেলাম। হটাৎ নীলা বলল, আমার দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে! আমি কোনো কিছু না ভেবেই বললাম চলো যাই। রাত ১১ টায় আমরা একটা বাসে উঠে পড়লাম। বাস কোথায় যাবে আমাদের জানার কোনো প্রয়োজন নেই। কারন, বাস যেখানে যাবে, আমরা যাবো। শেষ গন্তব্যে নেমে যাবো। কিছু সময় সেখানে থেকে আবার আরেক বাসে উঠে ঢাকা ফিরে আসবো। কোনো রকম ভাবনা চিন্তা না করেই, আমরা রওনা দিলাম। ভাবটা এরকম— যা ঘটার ঘটুক। আমরা কেয়ার করি না। সবচেয়ে বড় কথা নীলা পাশে থাকলে, আমার নিজেকে মিশরের সম্রাট বলে মনে হয়।
শীতের রাত! শেষমেশ বাস ছাড়লো রাত ১২ টায়।
সে বছর অনেক শীত পড়েছিলো। শা শা করে বাস চলছে! নীলা বার বার আমাকে জড়িয়ে ধরছে। যেন আমাকে জড়িয়ে ধরলে তার শীত কমে যাবে। অথবা আমি তার প্রেমিক। কিংবা আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে আমরা হানিমুনে যাচ্ছি। যাইহোক, রাত দুটার দিকে বাস থামলো, বিশাল এক রেস্টুরেন্টের দিকে। রেস্টুরেন্টের নাম নূর জাহান। আমাদের বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল। আমরা ভাত মাছ খেলাম। রান্না ভালো ছিলো। তারপর দই মিষ্টি খেলাম। বাসে উঠার আগে আমি একটা সিগারেট ধরালাম। নীলা বলল, আমাকেও একটা সিগারেট দাও। দিলাম নীলাকে সিগারেট। সে এক টান দিয়েই খুক খুক করে কাশতে শুরু করলো। বলল, এই বাজে জিনিস এত আগ্রহ নিয়ে খাও কিভাবে!
ভোর সাড়ে চারটায় আমরা বাস থেকে নামলাম।
বাস থেকে নেমেই আমরা শীতে ঠক ঠক করে কাপছি। প্রচন্ড প্রচন্ড এবং প্রচন্ড শীত। কই যাবো, কি করবো কিছুই জানি না! সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গা। একটা চায়ের দোকান খোলা পেলাম। পরপর দু'কাপ করে চা খেলাম। না শীত কমে না। চায়ের দোকানে আর কতক্ষণ বসে থাকবো! লোকজন কেমন চোখে যেন আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। তারা হয়তো ভাবছে, এই পরীর মতো সুন্দর মেয়েটাকে নিয়ে আমি পালিয়েছি। আমরা হাটতে শুরু করলাম। এই তো আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। চারিদিকে গভীর কুয়াশা। এত কুয়াশা আমি জীবনে দেখিনি। নীলা আর আমি কুয়াশা দেখে মুগ্ধ! হঠাৎ নীলার কি হলো কে জানে! আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেলো। অপ্রত্যাশিত আনন্দে আমি অভিভূত। জীবনে প্রথম কোনো নারী আমাকে চুম্বন করলো।
আমরা কিছুটা ক্লান্ত। নীলা বলল আর হাটতে ইচ্ছে করছে না।
এই ভোর বেলা, তীব্র কুয়াশার মধ্যে একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। রিকশা চালককে মনে হলো দেবদূত। আমরা রিকশায় উঠে বসলাম। কুয়াশা ভেদ করে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে! কুয়াশায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রিকশা চালক কিভাবে রিকশা চালাচ্ছে কে জানে! শীতে আমরা জুবুথুবু। দুজন দুজনের হাত ধরে রেখেছি। যেন আমাদের কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। নো নেভার। আমার মনে হচ্ছে রিকশা চলেছে বেহেশতের কোনো পথ দিয়ে। এত আনন্দ জীবনে আর কখনো পাইনি। ভোরবেলা আমরা একটা হোটেলে উঠি। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুর বেলা একটা বাসে উঠে ঢাকার দিকে রওনা দেই। এই ঘটনার উপসংহার হচ্ছে, নীলার সাথে আমার বিয়ে হয়নি। প্রায় এক যুগ হয়ে গেলো নীলার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। তবে নীলার জন্য আমার ভালোবাসা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


