খুব ঝামেলায় পড়েছি। কোন ভাবেই সমাধান পাচ্ছিনা। আমার আম্মু পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে এখন সৌদিআরব রয়েছেন। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। বাসায় একলা আছি। রান্না-বান্না করেই খাচ্ছি। মাঝে মাঝেই প্রতিবেশিরা সাহায্য করছেন। কলেজ, রান্না, বাসা আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই চলছিল। কিন্তু সমস্যা হল অন্যখানে, বাসার ছাদে একটা স্টোর রুম আছে সেটা কয়েক বছর ধরেই চোর কিসিমের বজ্জাত এক বিড়াল তার প্রসব কেন্দ্র বানিয়েছে। তার ভয়ে খাবার টেবিলে কিছু রাখা যায় না এবং দরজা খোলা রাখা যায় না। আম্মু যাওয়ার আগে তার বিষয়ে আমাকে সাবধান করে গেছে। বজ্জাত বলার আরও একটা কারণ আছে। এই বজ্জাত বিড়াল খুব দ্রুত প্রসূতি হয় এবং তিন চারটা করে বাচ্চা প্রসব করে। যথারীতি সে বাচ্চাগুলোর যত্ন নেয় না। বাচ্চাগুলো মারা যায়। কালে ভদ্রে দু-একটা বাঁচে। এবারও সে তিনটা বাচ্চা প্রসব করেছে। দুইদিন আগে রাত্রে ওদের চিৎকারে বের হয়ে দেখি সিঁড়িতে ডিগবাজি খেতে খেতে পড়ে যাচ্ছে আর কাঁদছে। আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি এই বিড়ালের বাচ্চা গুলো উপর থেকে পড়েই যেয়ে মারা যায় বেশি। ওটাকে ধরে ছাদের রুমে দিয়ে আসি নিচে এসে লাইট বন্ধ করতে না করতেই আবার সিঁড়ির কাছে চলে আসে। এবার দুইটা। এইভাবে দিয়ে আসি আর ওরা বের হয়ে যায়। এমন হল পাঁচ ছয় বার। দরজার নিচে ফাঁকা আছে। ফাঁকা বন্ধ করতে পারছিনা কারণ তাহলে ওদের মা ঢুকতে পারবে না। ময়লা ফেলার ঝুড়িতে রাখতে যেয়ে দেখি দুইটার একটা করে চোখ ময়লায় আঁটকে আছে খুলতে পারে না। নিচে এসে ডেটল পানি দিয়ে টিস্যু দিয়ে চোখ পরিস্কার করে মলম লাগিয়ে দিলাম। ওদের চিৎকার থামে না। রাত দুইটা বাজে। ওদের বজ্জাত মা আসেনি। বুঝলাম খিদের জন্য কাঁদছে। ফ্রিজ খুলে দেখি দুধ নাই। আমি দুধ একদম পছন্দ করি না এবং খেলে হজম করতে সমস্যা হয়। এজন্য আম্মু ফ্রিজে অনেক কিছু স্টক করে রেখে গেলেও দুধ রেখে যায়নি। এত রাতে দুধ কোথায় পাব?? ওদের না খাইয়েই ঝুড়িতে করে ছাদের রুমে রেখে আসলাম। সারা রাত কেঁদেছে। আযানের আগেই ওদের ডাকে ঘুম ভাঙল। নিচে নিয়ে আসলাম। আলো ফুটলে অনেক খুঁজে দুধ কিনে আনলাম। অত সকালে দোকান খোলে না। দুধ কিনতে যেয়ে আজব এক অনুভূতি হল। আমি বিড়ালের বাচ্চার জন্য দুধ কিনছি। অথচ আমার দেশেই কত শিশু না খেয়ে থাকে। আফ্রিকায় শিশুরা কঙ্কাল হয়ে মারা যাচ্ছে তার ছবি তুলে মানুষ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাচ্ছে। ড্রপার দিয়ে ওদের দুধ খাওয়ালাম। খেতে চায়না। ড্রপার শক্ত হওয়ায় কয়েক ফোঁটা দুধ দিলেই মুখ সরিয়ে নেয় আর আমার হাতে মুখ ঘষতে থাকে। বুঝলাম ওদের মাকে খোঁজে। আমার শব্দ পেলেই উল্টে পাল্টে দৌড় দিয়ে পায়ের পাতার উপর উঠে মুখ ঘসতে থাকে। খুব মায়া হয়ে গেল। কলেজ শেষে দ্রুত বাসায় চলে আসি। বার বার মনে হচ্ছিল বিড়ালের বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে। এটা একটা অদ্ভুত ফিলিংস। অন্য কাজ করছি কিন্তু ওদের জন্য টেনশন হচ্ছে। মাঝে মাঝে হাসিও পাচ্ছিল। বিড়ালের বাচ্চার জন্য আমার এমন হওয়ার তো কোন কারণ নেই। মায়ায় ধরেছে আমাকে। ওদের নাম দিলাম ইট্টুস, মিট্টুস আর পুট্টুস। রাত্রে খাওয়ায়ে রেখে আসি কিন্তু ওদের কান্না থামেনা। কেন কাঁদে বুঝলাম না। সকালে দেখি একটা মারা গেছে। বাচ্চা বিড়ালটা খুব সুন্দর ছিল ওর নাম রেখেছিলাম ইট্টুস। সারাদিন মন খারাপ ছিল। কলেজ শেষে দ্রুত বাসায় এলাম দেখি মিট্টুস আর পুট্টুস ঘুমাচ্ছে। প্লাস্টিকের ঝুড়ির বাহিরে। বুঝলাম ওদের মা এসেছিল অবশেষে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গেছে। রান্না করে খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। খাওয়ার সময় আবার মনে হল বিড়ালের বাচ্চার জন্য আমার এত মায়া উছলে পড়ছে কিন্তু মানুষের জন্য ?? !!!!! আমিতো তাদের দেখছি না, তাই মায়া হচ্ছেনা এবং ওদের জন্য কিছু করছিও না। অথচ আমিও ওদের মত মানুষ !!!
সারা বিশ্বে বিভিন্ন কারণে শিশুমৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম যুদ্ধ, খাদ্যাভাব, অপুষ্টি। বাংলাদেশে বর্তমানে শিশু মারা যায় প্রতি হাজারে ৩৪৭ জন। তবে গত ২২ বছরের তুলনায় এটা কমেছে। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু হার কমেছে ৭২ শতাংশ (ইউনিসেফ, সেভ দ্যা চিলড্রেন)*১, দেশে অপুষ্টির কিছুটা উন্নতি হয়েছে কিন্তু বেড়েছে বিভিন্ন এলাকার মধ্যে পুষ্টি বৈষম্য। দরিদ্র পরিবারের শিশু অপুষ্টির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি (জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান) *২, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। যেমনঃ দিনাজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জয়পুরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর। ক্রমবর্ধমান খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা প্রোগ্রামের সমন্বয় ও এতে বিনিয়োগ করার অভাব এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশে খাদ্যাভাবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সামনে আরো বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে (জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাকের ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভিলেন্স, সেভ দ্য চিলড্রেন- 'এ চান্স টু গ্রোথ ২০১২') *৩
শিশু-মৃত্যু হারের বিচারে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪৬তম (The state of the world’s children-2011, UNICEF)। মানব সম্পদের সার্বিক উন্নয়নে ভারত আছে বিশ্বের ১৬৯টি দেশের মধ্যে ১১৯তম স্থানে (UN-Human development report-2010)। বিশ্বের উন্নয়নশীল ৮৪টি দেশের প্রত্যেকটিতে মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ খাদ্যাভাবে ক্ষুধার্ত থাকে। সেই সূচকে ভারতের স্থান ৬৭তম। বিশ্ববাসীর ১৭ শতাংশের বাস ভারতে, আর ঐ ক্ষুধা কাতর অভাগা মানুষের ৩৪ শতাংশের বাসই ভারতে (Global Hunger Index 2011 – International Food Policy Research Institute)।*৪
একদিকে একটানা দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে সীমাহীন অত্যাচারে সোমালিয়ার মানুষ বাঁচার আশায় তাকিয়ে আছে সমগ্র বিশ্বের দিকে। গত ৬০ বছর ধরে চলছে এই দুর্ভিক্ষ আর তাতে প্রায় ৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ইথিওপিয়া, কেনিয়াও এর থেকে রেহাই পায়নি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, এই বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ২৯০০০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে যাদের বয়স ৫ বছরও হয়নি। জাতিসংঘের হিসাবে ৬ লাখ ৪০ হাজার সোমালী শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, ফলে শিশু মৃত্যুর হার আরো বাড়বে। প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে একটি করে শিশু মারা যায় খাদ্যাভাবে ও অপুষ্টিতে। শুধু সোমালিয়াতেই নয়, দুর্ভিক্ষের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের অনেক অঞ্চলে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী দক্ষিণেও প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।*৫
অন্যদিকে সারা বিশ্বে ১৯৯০ সালে পাঁচের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ২৬ লাখ, যা ২০১২ সালে এসে দাঁড়ায় ৬৬ লাখে। গত ২২ বছরে ছোটখাটো কিছু প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে প্রায় ৯ কোটি প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলো। এই অঞ্চলে শিশু মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। পাঁচের কম বয়সী প্রতি আটটি শিশুর মধ্যে একটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে সামগ্রিকভাবে পুরো বিশ্বের জন্য চিত্রটি আশাপ্রদ নয়।বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এমডিজি পূরণের নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জন করা সম্ভব হবে না (ইউনিসেফ) *৬
আর ভালো লাগছে না। এত মৃত্যু, শুধু ক্ষুধা আর অপুষ্টির। যুদ্ধের কারণে প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান, সিরিয়া, আফ্রিকায় কত মৃত্যু ঘটছে তার বর্ণনা না হয় আরেকদিন দেয়া যাবে।
১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গ- এর "সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড" কবিতার কয়েকটা লাইন কানে ভাসছে, মৌসুমি ভৌমিকের তীব্র কণ্ঠে......
......গরুগাড়ী কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে, লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়,
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।
রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু, পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ দিশেহারা মা কারকাছে ছোটে।
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, এত এত শুধু মানুষের মুখ,
যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ।
কারকাছে বলি ভাতরূটি কথা, কাকে বলি করো, করো করো ত্রান,
কাকে বলি, ওগো মৃত্যু থামাও, মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রান।
কাঁদো কাঁদো তুমি মানুষের দল তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা,
জননীর কোলে আধপেটা শিশু একেমন বাঁচা, বেঁচে মরে থাকা।
ছোটো ছোটো তুমি মানুষের দল, তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া,
গুলিতে ছিন্ন দেহ মন মাটি, ঘর ছেড়ে ছোট মাটি মিছে মায়া...
......কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে ... ???
( *১, UNICEF, Save the Children, The Daily Star, Kalerkantho।
*২, *৩; এম জেড মাহমুদ- শিশুরা বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দৈনিক ডেসটিনি; নিপোর্ট।
*৪, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কংগ্রেস সরকারের দায়িত্বহীনতা-কান্তি বিশ্বাস, গণশক্তি; The Times of India.।
*৫, সোমালিয়া: দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর মোকাবিলা-মনির তালুকদার, সাপ্তাহিক খোঁজ খবর, BBC World News, Wikipedia.।
*৬, independent24.tv, carebd.org, IndexMundi, Kalerkantho, banglanews24.com)