ভাষার জন্য জীবন দেয়ার উদাহরণ একটা বিরল ঘটনা। আমরা, বাংলাদেশীরা সে জন্য গর্ব করতে পারি। আর আমাদের এই গর্বের স্বীকৃতি মিলেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিতেই ২১শে ফেব্রুয়ারিকে করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
বাংলা ভাষাকে পরিচর্চা করার দায়িত্ব আমাদের। নি:সন্দেহে বাংলা একটি সমৃদ্ধ ভাষা। বিভিন্ন ভাষা থেকে এ ভাষা শব্দগ্রহণ করেছে কোন রকম ছুঁতমার্গ বিচার না করে। বাংলাভাষার অনেক শব্দ সরাসরি হিন্দু ধর্মীয় আচার-উপাচারের সাথে যুক্ত। কোন কোন শব্দের তাৎপর্য সরাসরি ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু অনেক আলেম-উলামাও এ সকল শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। ব্রহ্মাণ্ড শব্দটির কথাই ধরা যাক। ব্রাহ্মাণ্ড শব্দের অর্থ বৃহ্মের অণ্ড বা ডিম। ব্রহ্মা হলেন বিষäু ও শিবের সমকক্ষ প্রধান দেবতা। ব্রহ্মের অণ্ড মানে ব্রহ্মের সৃষ্টি। যার অর্থ দাঁড়ায় সমস্ত মহাবিশ্ব। অর্থাৎ এই মহাবিশ্ব ব্রহ্মার সৃষ্টি। কিন্তু এই শব্দটি বাংলা ভাষায় এভাবে চালু হয়ে গেছে যে, ধর্মীয় অর্থ এখন আর কেউ অনুসান করেন না। অর্থাৎ বাংলা ভাষা শব্দটিকে মহাবিশ্ব'র প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
আমরা প্রায়ই পত্রিকায় দেখি, নেতারা গণমানুষকে বিভ্রান্ত করে কেবল নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ধান্দায় থাকেন। এই বৈতরণী শব্দটা এত বেশি স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, এর ধর্মীয় গুরুত্ব সমে অনেকেরই কোন ধারণা নেই। বৈতরণী হলো যমদ্বারের নিকটস্খ নদী। এই নদী পার হয়ে স্বর্গে যেতে হয়। অনেকটা ইসলাম ধর্মের পুলসিরাতের মতো।
সূরের ইন্দ্রজাল বা রূপের ইন্দ্রজালে আবিষ্ট হওয়ার কথা আমরা অনেকবার পড়েছি। এই ইন্দ্রজাল শব্দটি সরাসরি হিন্দু দেবতা ইন্দ্রের সাথে সম্পর্কিত। দেবতা ইন্দ্রের দৈব শক্তির প্রকাশকেই বলা হয় ইন্দ্রজাল। এই ইন্দ্রজাল শব্দটাও বাংলা ভাষা আপন করে নিয়েছে। সাম্প্রদায়িক এই শব্দটাকে মুসলমানরাও কোনরকম উন্নাসিকতা ছাড়াই ব্যবহার করে থাকে।
এরকম আরেকটি শব্দ বালখিল্য বালক বা অপরিপক্কতার প্রতিশব্দ হিসেবে মুসলিম সমাজেও শব্দটিকে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু শব্দটির উৎস যথেষ্ট কৌতূহল উদ্দীপক। হিন্দু ধর্মের একজন প্রধান দেবতা অন্য একজন দেবতার বিয়ের পৌরহিত্য করতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানে পুত্র সম্পর্কিত দেবতার কনের রূপ দেখে পুরহিত দেবতার কামাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। এই কামভাবের আধিক্যে পুরহিত পিতৃ সম্পর্কীয় দেবতার বীর্য স্খলন ঘটে। বৃদ্ধ দেবতা এতে লজ্জাবোধ করে। সে বালি দ্বারা স্খলিত বীর্য লুকোবার চেষ্টা করে। কিন্তু দেবতার বীর্য নিষ্ফল হতে পারে না। সেই বালি আচ্ছাদিত বীর্য থেকে সৃষ্টি হয় একদল মুনি। তাদের নাম হয় বালখিল্য মুনি। এই বালখিল্য শব্দটি এসেছে এখান থেকে।
বিভীষিকা আরেকটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। বিভীষণ থেকে এসেছে এই শব্দটি। মৃত্যুর প্রতিশব্দ হিসেবে অগস্ত্যযাত্রা শব্দটি বহুল প্রচলিত। এই শব্দের উৎসটিও বেশ চমকপ্রদ। অগস্ত্য নামের একজন মুনি পয়লা ভাদ্র। ব্যিপর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণাপথে গমন করেছিলেন এবং আর ফিরে আসেননি। এ থেকেই মৃত্যুর প্রতিশব্দ হিসেবে এই শব্দটি বাংলা ভাষায় তার আসন গড়ে নেয়। এরকম আরো হাজার হাজার উদাহরণ দেয়া যায়। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত দেব-দেবী এবং পূজা অর্চনাকে ভিত্তি করে বাংলা ভাষায় যে হাজার হাজার শব্দ এসেছে তা কিন্তু বাংলা ভাষাকে সাম্প্রদায়িক করে তোলেনি বরং সমৃদ্ধ করেছে। নিয়মও তাই। যে ভাষা যত গতিশীল, সে ভাষা তত সমৃদ্ধ। মধ্যযুগে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়েছেন মূলত: মুসলমান কবিরা। পরবর্তীতে অবশ্য হিন্দুদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। মুসলমানরা অনেক আরবী-ফার্সী শব্দে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। হিন্দু লিখিয়েরা রামায়ণ-মহাভারত থেকে অনেক উপাদান এনে বাংলা ভাষাকে আরো উন্নত করেছেন। আসলে ভাষা ও সংস্কৃতিতে ধর্মীয় প্রভাব থাকবেই। গণমানুষের চিন্তা-চেতনা এবং ব্যবহৃত শব্দই একসময় ঐ অঞ্চলের ভাষা আত্মস্খ করে নেয়।
বাংলাদেশীদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এই বাংলাদেশীদের শতকরা নব্বই জনই ধর্মীয় বিশ্বাসে মুসলমান। সঙ্গত কারণেই ভাষাকে গতিশীলতার মধ্যে পরিচর্চা করতে গেলে শতকরা নব্বই জন মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুরণীত বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ ভাষায় প্রবেশ করবেই। কিন্তু কৌলিন্য রোগে আক্রান্ত তথাকথিত একটি মহল শতকরা নব্বই জন মানুষের ধর্মীয় আবেগ থেকে উৎসারিত বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দকে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করা থেকে ঠেকিয়ে রাখতে প্রাণান্ত কসরত করে যাচ্ছে। দু'একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
সর্বাধিক প্রচার সংখ্যার দাবিদার একটি দৈনিক এবং এর সহযোগী আরো কয়টি দৈনিক ও সাপ্তাহিকে একটু মনোযোগের সাথে চোখ রাখলে আপনি অনেক তেলেসমাতি দেখতে পাবেন। সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকটিতে ক'দিন আগে একজন নামি-দামি ব্যক্তির মৃত্যুর খবর প্রচার করে লেখা হয়- তার মরদেহ বিদেশে অবস্খানরত ছেলেমেয়েদের শেষবার দেখার জন্য বারডেমে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। বলাবাহুল্য, মৃত ব্যক্তি মুসলমান এবং সম্ভবত তার বিদেশে অবস্খানরত ছেলেমেয়েরাও লাশকে মরদেহ বলবে না। আজকাল ইংরেজির প্রভাবে কলেজ-ািবশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত মানুষ অবশ্য লাশকে ডেড বডিও বলে, কিন্তু মুসলমান কাউকে আমি মরদেহ বলতে শুনিনি। এই যে মহলটি ‘লাশ'কে ঠেকিয়ে রাখার প্রাণান্ত কসরত করছে, আমরা বালখিল্য মুনি থেকে আগত শব্দের রেশ ধরে বলতে চাই, তাদের এই বালখিল্যতার হেতু কী?
‘নিমন্ত্রিত অতিথি' শব্দটি বহুল প্রচারিত এবং আমরা শব্দটা ব্যবহারে কোন হীনমন্যতায় ভুগি না। কিন্তু ‘দাওয়াতী মেহমান' শব্দটাও এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ হওয়ার দাবি রাখে। আমরা নিমন্ত্রণ খেতে পারি এবং দাওয়াত দিতেও পারি। আমরা আশীর্বাদ শব্দ ব্যবহারে দোষ ধরি না। কিন্তু ‘দোয়া' শব্দটি ব্যবহার না করার পেছনে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার গ খুঁজে পাই। মুসলমানরা আনন্দ প্রকাশের বেলায় ‘মারহাবা' শব্দটি ব্যবহার করে। কিন্তু এই সব শব্দকে ঠেকিয়ে রাখার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
সবচেয়ে মারাত্মক অপকর্মটি করা হচ্ছে ‘আল্লাহ্' শব্দটি ব্যবহার না করে ‘ঈশ্বর' বা ‘প্রভু' ব্যবহার করায়। তথাকথিত প্রগতিশীলতার দাবিদাররা কোন মতলবে ‘আল্লাহ্' শব্দটি এড়িয়ে যান, তা বেশ রহস্যময়। আমরা জানি ‘আল্লাহ্' শব্দের কোন প্রতিশব্দ নেই। এই শব্দটি মুসলমানদের সবচেয়ে প্রিয় শব্দ। দেশী-বিদেশী ফেরকা সৃষ্টি করে ‘আল্লাহ্' শব্দ ব্যবহার না করার কোন কারণ থাকতে পারে না। তাছাড়া বাংলা ভাষায় অধিকাংশ শব্দই বিদেশী। এই হিসেবে মুসলমানের বোধ-বিশ্বাসের সাথে জড়িত শব্দগুলো ব্যবহার না করার পেছনে কোন ষড়যন্ত্র থাকাটা বিচিত্র নয়।
এদিকে আরেকটি পত্রিকা সমানে ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। না, আমরা ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু ভাষার গতিময়তা এবং সাবলীলতার কথাটিও ভাবতে হবে। পত্রিকাটি বাধ্যতামূলকভাবে কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে। তারা ভারতকে লিখছে ইনডিয়া, মিসরকে লিখছে ইজিপ্ট, প্রধানমন্ত্রীকে লিখছে প্রাইম মিনিস্টার, নির্বাচনকে লিখছে ইলেকশন, রাজনীতিকে লিখছে পলিটিক্স, প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লিখছে চীফ ইলেকশন কমিশনার, নেতাকে লিখছে লিডার ইত্যাদি।
ভাষা শহীদদের রক্তের ঋণে অর্জিত রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং মহান স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে অর্জিত রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাকে লালন ও পরিচর্চা করার একক দায়টি এখন আমাদের। সেই দায়টি আমাদের যথাযথভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু আমরা পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করছি, সাম্রাজ্যবাদীদের দেশীয় এজেন্ট এবং দাসত্ব মানসিকতার তথাকথিত প্রগতিশীলতার দাবিদার একটি মহল আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তার নিজস্ব গতিতে বিকশিত হতে দিচ্ছে না। তারা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে অতীতমুখী আবর্তে আচ্ছন্ন করতে হামেশা পানি ঘোলা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ভাষা ও সংস্কৃতি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। এর তুলনা হতে পারে এঁকেবেঁকে চলা প্রবহমান ঝর্ণাধারার সাথে সময়ের সাথে সাথে ভাষা ও সংস্কৃতি তার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন করবে- এটাই নিয়ম। প্রগতির দাবিও তাই। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বহিরাগত আর্যদের প্রভাবে যেমন প্রভাবিত হয়েছে, তেমনি মুসলমান ও ইংরেজদের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিবেশে নিজস্ব মাত্রচিত্র, জাতীয়তা ও বোধ-বিশ্বাস দ্বারা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রভাবিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। নদীর প্রবাহকে আটকিয়ে দিলে যেমন মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় তেমনি ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক প্রবাহকে আটকিয়ে দিলেও ভাষা ও সংস্কৃতির মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। অপ্রিয় সত্য হলো, ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে মরুকরণের মতো এ ক্ষেত্রেও তাই করা হচ্ছে। আর এ সুযোগে বিদেশী সংস্কৃতি আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে এখনই আমাদের সতর্ক হতে হবে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আমাদের দেশ, মানচিত্র, জাতীয়তা ও বোধ-বিশ্বাসের আদলে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সমস্ত ষড়যন্ত্রকে বুদ্ধিক ও যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় প্রতিহত করতে হবে। আর এই গুরুভার দায়িত্বের বড় অংশটারই দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের তরুণ সমাজকে।