somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফতোয়ার নানা রূপ - ৩

২২ শে অক্টোবর, ২০০৭ রাত ৩:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলি যাত্রা উপন্যাস, প্রভাতকুমারের পুঁইমাচা গল্প এবং শরত্‍চন্দ্রের অরক্ষণীয়াসহ বহু কথাসাহিত্যে তত্‍কালীন হিন্দু সমাজের নাবালিকা বিবাহপ্রথার নিষ্করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ৷ আসলে অরক্ষণীয় প্রথাও ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজপতিদের ধর্মের নামে প্রদত্ত ফতোয়াবাজি ছাড়া অন্য কিছু নয় ৷ শরত্‍চন্দ্রের 'বিলাসী' গল্পের বর্ণিত 'অন্নপাপ' কি ফতোয়াবাজি নয়? ঐ গল্পে সাপের দংশনে মৃত্যুঞ্জয়ের অকাল মৃত্যু সম্পর্কে সমাজপতি খুড়া বলছে :

"গ্রামটা এবার রসাতলে গেল ৷... অকালকুষ্মাণ্ডটা একটা সাপুড়ের মেয়ে নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে ৷ আর শুধু নিকা নয়, তাও না হয় চুলায় যাক, তাহার হাতে ভাত পর্যন্ত খাইতেছে ৷... পুরুষ মানুষ অমন একটা ছেড়ে দশটা করুক না, তাতে তো তেমন আসে যায় না, না হয় একটু নিন্দাই হত ৷ কিন্তু হাতে ভাত খেয়ে মরতে গেলি কেন?... অন্নপাপ ৷ বাপরে! এর কি আর প্রায়শ্চিত্ত আছে?"


সবর্ণ বিবাহপ্রথার বিরুদ্ধে অসবর্ণ বিয়ে বর্ণাশ্রমবাদী বাঙালী হিন্দু সমাজে এক বিপ্লবাত্মক ঘটনা ৷ এই অসবর্ণ বিবাহপ্রথার বিরুদ্ধেও তখন কম ফতোয়াবাজি হয়নি ৷ বর্তমানে সেই অসবর্ণ বিয়েতে কোন কোন ধর্মবেত্তা যাজক ব্রাহ্মণদের 'অনুলোম-প্রতিলোম' বিচার ফতোয়াবাজির নতুন সংস্করণ বলে মনে হয় ৷ 'অপাংক্তেয়' শব্দটির অর্থ একালে যদিও পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তবু এককালে শব্দটির অর্থ ছিল যারা একই সারিতে বসে ভোজনের উপযুক্ত নয় ৷ সেকালে বর্ণাশ্রম প্রথার কারণে তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে একই পংক্তিতে বসে ভোজন করতে পারতো না ৷ এখনো বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই ফতোয়াবাজি প্রচলিত আছে ৷

তবে সমাজ বিকাশের গতিধারা ও ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং সংস্কৃতিগতভাবে উনিশ শতকের বাঙালী হিন্দু নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী সমসাময়িক মুসলিম সমাজের চেয়ে অগ্রসর ৷ ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হিন্দু সমাজে একালে অপেক্ষাকৃত কম বলে ফতোয়াবাজির ক্ষতিকর প্রভাব এখন নগণ্য ৷ পক্ষান্তরে বাঙালী মুসলিম সমাজের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ও আচরণবিধি অবশ্য পালনীয় বলে এবং বিশেষভাবে বিদ্যাবঞ্চিত গ্রামীণ সমাজে অনুদার যুক্তিহীনতা ও ধর্মভীরুতার সারল্যের সুযোগে ফতোয়াবাজির প্রকোপ বেশি ৷

এখনও গ্রামবাংলায় মধ্যযুগীয় ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের অবশেষ-প্রতিভূরা এবং মাদ্রাসায় সামান্য ধর্মীয় শিক্ষা-প্রাপ্তরা রাজত্ব করছে ৷ একদলের আছে জমি-জিরেত, অন্যদলের মাজার-মক্তব ৷ এদের যৌথ প্রয়াসে শিক্ষার আলোহীন গ্রামের সরলপ্রাণ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত ৷ মোল্লাতন্ত্র যত্‍সামান্য আরবী শিক্ষার জোরে পবিত্র ধর্মকে অপব্যাখ্যায় কলুষিত করছে ৷ ফতোয়াবাজি সেই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ও শ্রেণীস্বার্থপর গ্রাম্য মোড়ল-মুন্সি এবং তাদের দোসর টাউট-বাটপারদের গণবিরোধী অপতত্‍পরতার সাক্ষ্য ৷

ধর্মনির্বিশেষে ফতোয়াবাজি মাত্রই মানবতা ও শুভবুদ্ধি বিরোধী, ধর্মের যুক্তিহীন অপব্যাখ্যা এবং শিক্ষাবঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্রজনগোষ্ঠীকে নির্যাতনকারী প্রক্রিয়া ৷ তবে আলোচনার সুবিধার্থে এবং এর স্বরূপ উন্মোচনের লক্ষ্যে ফতোয়াবাজিকে মোটাদাগে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভাজন করা যায় ৷

যেমন :
প্রগতিশীল রাজনীতি-বিরোধী ফতোয়াবাজি; শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি-বিরোধী ফতোয়াবাজি; নারীবিরোধী ফতোয়াবাজি; ধর্মের অনুশাসন ব্যাখ্যায় ফতোয়াবাজি; রাজনীতিকদের ফতোয়াবাজি; বিচিত্র ধরনের ফতোয়াবাজি ৷

ফতোয়াবাজি প্রতিক্রিয়াশীলতার একটি উপসর্গ ৷ ধর্মের নামে অন্ধত্ব, পশ্চাত্‍পদতা, মধ্যযুগীর ধ্যানধারণার বশবর্তী কূপমণ্ডূকতা এবং সকল ধরনের প্রগতিবিরোধী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অপতত্‍পরতাই ফতোয়াবাজদের লক্ষ্য ৷ তাই সমসাময়িক কালচেতনার মানদণ্ডে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল রাজনীতি ও রাজনীতিকরা সর্বদা ফতোয়াবাজদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৷

ফতোয়া দ্বারা মুক্তবুদ্ধির চেতনা, প্রগতিশীল রাজনীতি এবং সংস্কারমুক্ত দর্শন যেমন আক্রান্ত হয়েছে তেমনি রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদরা, যাঁরা প্রাগ্রসর জীবনদর্শনে বিশ্বাসী, ফতোয়াবাজদের কালোহাতের থাবা থেকে রেহাই পাননি ৷

একথা কারও অজানা নয় যে, চুয়ান্ন সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় এদেশের বহু মুফতি-মৌলানা-পীরেরা ফতোয়া দিয়েছিল : যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীকে ভোট দিলে মুসলমানিত্ব খারিজ হয়ে যাবে ৷ শুধু তা-ই নয়, আরও আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ ফতোয়া দিয়েছিল যে, স্ত্রী পর্যন্ত তালাক হয়ে যাবে ৷ ষাটের দশকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ যখন প্রার্থী হয়েছিলেন তখনও এরকম ফতোয়া জারি করা হয় ৷

কিন্তু আমাদের কথা এই যে, এদেশের ধর্মপ্রাণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এরকম রাজনৈতিক ফতোয়াবাজিতে বিভ্রান্ত হয়নি ৷ তাছাড়া 'ইসলামে নারীনেতৃত্ব নাজায়েজ' বলে ফতোয়া দিয়ে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের শঠ নেতারা এদেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা করে আসছে ৷ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায় যখন এদেশে নারীনেতৃত্ব অগ্রগতি লাভ করে এবং নির্বাচন হয় আসন্ন তখনই নারীনেতৃত্ব বিরোধী কুত্‍সাপ্রবণ ফতোয়ার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায় ৷

চলবে........
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×