somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রহস্যময় মহাবিশ্ব ও চিরন্তন জীবন জিজ্ঞাসা -৩

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৫:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রহস্যময় মহাবিশ্ব ও চিরন্তন জীবন জিজ্ঞাসা -৩
-------------------------------------ডঃ রমিত আজাদ

অপার রহস্যে ঘেরা আমাদের এই মহাবিশ্ব। আর তার মধ্যে রহস্যময় একটি সত্তা আমরা - 'মানুষ'। এই দু'য়ের সম্পর্কও কম রহস্যময় নয়। মহাবিশ্বের বিবর্তন বা বিকাশের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ফলাফল মানুষ, সেই মানুষই আবার গভীর আগ্রহ নিয়ে অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ করছে তার চারপাশের মহাবিশ্বটিকে। কি এই মহাবিশ্ব? আমরা কারা? কি সম্পর্ক মহাবিশ্বের সাথে আমাদের অথবা আমাদের সাথে মহাবিশ্বের? কোথা থেকে এল এই মহাবিশ্ব? তারপর থেকে ক্রমাগত কি ঘটছে? এর শেষ কোথায়? এই সব প্রশ্ন অবিরাম ঘুরে ফিরে মানুষের মস্তিস্ক থেকে হৃদয় আর হৃদয় থেকে মস্তিস্ক পর্যন্ত। এইসব চিরন্তন জীবন জিজ্ঞাসার যতটুকু উত্তর এ যাবতকাল আমাদের জানা হয়েছে দর্শন ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে। সেইসব উত্তর ধারাবাহিকভাবে দেয়ার চেষ্টা করব আমার এই সিরিজে।
প্রথম পর্বে বস্তু (matter) সম্পর্কে কিছু আলোচনা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হয়েছে গতি (motion) নিয়ে। এবারের পর্বে আলোচনা করব স্থান ও কাল (space and time) নিয়ে।
প্রথম পর্বের আলোচনা নিম্নের লিংকে পাবেন
Click This Link
দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা পাবেন নীচের লিংকে
Click This Link

স্থান ও কাল

স্থান কি ও কাল কি এই জিজ্ঞাসাও মানুষের চিরন্তন। মানব জ্ঞান ও মানব জাতির ইতিহাসে এটি মৌলিক প্রশ্ন সমূহের একটি। মানব ইতিহাসের গতিধারায় স্থান ও কালের ধারনাও পাল্টেছে বহুবার। বস্তুর এই গুনাগুন (attributes) দুইটিকে সম্মিলিত ভাবেই অধ্যয়ন করা হয়।

স্থানের প্রকৃতি, গুনাবলী ও অস্তিত্বের ধরণ নিয়ে বিতর্ক চলছে সেই অনাদিকাল থেকে। যেমন প্লেটোর ট্রিটিজ (treatise) Timaeus অথবা সক্রেটিসের khora (অর্থাত্ "স্থান"), অথবা এরিস্টটলের (ডেল্টা বইয়ের IV নং অধ্যয় ) topos (অর্থাৎ জায়গা)-এর সংজ্ঞা, অথবা ১১ তম এর শতাব্দীর আরব polymath আলহাজেন-এর “স্থান সম্পর্কিত ডিসকোর্স (Qawl fi al-Makan)”-এর মধ্যে "স্থানের জ্যামিতিক ধারণা" "space qua extension" হিসাবে আলোচিত হয়েছে।

রেনেসাঁ-র যুগেও এই সকল চিরায়ত দার্শনিক প্রশ্নগুলো আলোচিত হয়েছে । তারপর ১৭ শতাব্দীতে বিশেষত চিরায়ত বলবিজ্ঞানের প্রথম যুগে তাদেরকে পূণর্বিন্যাসও করা হয়েছে। স্যার আইজাক নিউটনের মতে, স্থান হচ্ছে পরম - অর্থাৎ স্থান স্থায়ীভাবে এবং স্বাধীনভাবে চিরকাল ছিল ও আছে। সেই স্থানে বস্তু থাকুক বা না থাকুক তার উপর স্থান নির্ভরশীল না।

গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস এবং এপিকুরাস মনে করতেন স্থান হলো সমসত্ত্ব (homogenous) ও অসীম শূণ্যতা, যা কম বেশী পরমাণু দ্বারা পরিপূর্ণ।

অন্যান্য প্রাকৃতিক দার্শনিকরা, যাদের মধ্যে Gottfried Leibniz-এর নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি ভেবেছিলান যে স্থান হচ্ছে বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের একটি সংগ্রহ, যা নির্ধারিত হচ্ছে একে অপরের থেকে তাদের দূরত্ব এবং দিকবিন্যাস দ্বারা। ১৮ শতাব্দীর দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ জর্জ বার্কলে তার রচনা "Towards a New Theory of Vision" - এ "স্থানিক গভীরতার দৃশ্যমানতা" (visibility of spatial depth) সম্পর্কে নতুন ধরনের বিবৃতি প্রদান করেন।
পরবর্তীতে, অধিবিদ্যাবিদ (meta-physician) ইমানুএল কান্ট বলেন স্থান বা সময় কাউকেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে (empirically) হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না, তারা একটি পদ্ধতিগত কাঠামোর উপাদান যা মানুষ তার সকল অভিজ্ঞতা কাঠামোগত করার জন্য ব্যবহার করে থাকে।

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গণিতবিদরা অ-ইউক্লিডিয় জ্যামিতি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন, যেখানে স্থান আর সমতল নয় বরং বক্র।
আমাদের এ যাবৎকাল যা জানা আছে তার মধ্যে সময় সম্পর্কে লিখিত প্রাচীনতম লেখাটি মিশরীয় চিন্তাবিদ প্টাহহোটেপ (Ptahhotep (c. 2650–2600 BCE))-এর তিনি বলেছিলেন: "Do not lessen the time of following desire, for the wasting of time is an abomination to the spirit." আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদ (খ্রীস্টপূর্ব ২০০০ সালে লিখিত বলে ধারণা করা হয়)-এ বিশ্বতত্ব (cosmology)-এর বর্ণনা রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে এই মহাবিশ্ব চক্রাকেরে বারংবার সৃস্টি, বিকাশ, ধ্বংস ও পূনর্জন্মের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি চক্রের বয়স ৪৩২০০০০ (তেতাল্লিশ লক্ষ বিশ হাজার ) বছর ।

গ্রীকরা যেমন ধারণা করেছিল যে, এই মহাবিশ্বের রয়েছে অসীম অতীত এবং এর কোন শুরু নাই। গ্রীকদের বিপরীতে মধ্যযুগীয় দার্শনিক ও ধর্মতত্ববিদরা এই ধারণা বিকশিত করেন যে, মহাবিশ্বের একটি সসীম অতীত ও প্রারম্ভ রয়েছে । এই দৃস্টিভঙ্গী উৎস হলো তিনটি আব্রাহামীক ধর্ম (Abrahamic religions): ইহুদী, খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্ম। যে সকল দার্শনিক এই ধারণাকে বিকশিত করেন তারা হলেন, খ্রীস্টান দার্শনিক জন ফিলিপোনাস, ইহুদী দার্শনিক সাদীয়া গাওন, মুসলিম দার্শনিক আল কিন্দি, আল গাজ্জালী প্রমুখ। অসীম অতিতের ধারণার বিপরীতে তারা দুইটি যুক্তি ব্যব হার করেন, প্রথমতঃ "সত্যিকারের অসীম বলে কোন কিছু থাকা সম্ভব না"। যা বলে "ঘটনসমুহের (events) অসীম সময়গত ক্রমাগত প্রত্যাবর্তনই হলো সত্যিকারের অসীম" (An infinite temporal regress of events is an actual infinite."), " "ঘটনসমুহের অসীম সময়গত ক্রমাগত প্রত্যাবর্তনের কোন অস্তিত্ব নেই (∴ An infinite temporal regress of events cannot exist)"
দ্বিতীয় যুক্তিটি হলো, " সত্যিকারের অসীমকে পরবর্তীকালীন যোগ দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব না (An actual infinite cannot be completed by successive addition.")। ড্বিতীয় যুক্তিটি খ্যাতিমান হয়ে ওঠে ইমানুয়েল কান্ট যখন তাকে তার নিবন্ধ the first antinomy concerning time - এ ব্যবহার করেন।১১ শতকের শুরুতে মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাজেন (Ibn al-Haytham (Alhacen or Alhazen) তার গ্রন্থ 'আলোকবিজ্ঞান'-এ স্থান উপলদ্ধি ও তার জ্ঞানতত্ব বিষয়ক প্রয়োগ (space perception and its epistemological implications ) নিয়ে আলোচনা করেন। পূর্বে স্থানের দৃষ্টিগত যে উপলদ্ধি ছিল, আল হাজেনের পরীক্ষামূলক প্রমাণের পরে সেই ধারনা বদলে যায়। তিনি টলেমি ও ইউক্লিডের স্বজ্ঞাজনিত স্থান উপলদ্ধি ( intuitiveness of spatial perception )-কে একবাক্যে বাতিল করেন, তিনি বলেন, পারস্পরিক সম্পর্ক স্থির করার লক্ষ্যে, আকৃতি ও দূরত্ব সম্পর্কে বাস্তব ধারণা না থাকলে দৃষ্টি আমাদেরকে প্রায় কিছুই বলতে পারবে না (Without tangible notions of distance and size for correlation, sight can tell us next to nothing about such things."

দক্ষিণ আমেরিকার ইনকারা স্থান ও কাল-কে একীভূত (single concept) মনে করত, তারা স্থান-কাল-এর একটি নাম দি্যেছে, পাচা (pacha), আন্ডিজ পর্বতমালার অধিবাসীরা এখনো এই ধারণাই পোষণ করে।

নিউটন-লেইবনিজ স্থান-কাল বিতর্কঃ
স্থান ও কাল নিজে নিজেই সত্যিকার অবজেক্ট (real objects ) নাকি তারা সত্যিকার অবজেক্ট সমূহের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক এই নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল দুই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী স্যার ইসাক নিউটন ( Isaac Newton ) ও গটফ্রীড লেইবনিজ (Gottfried Leibniz)-এর মধ্যে। স্যার ইসাক নিউটন মনে করতেন স্থান ও কাল বস্তুর উপর নির্ভরশীল নয়। স্থান আরও যথাযথভাবে বললে চরম স্থান হলো একটি শূণ্য আধার যা নানাবিধ কায়া (body) ধারণ করে। এই আধার (স্থান) গতিহীন, অবিরাম ও সকল বিন্দুতে ও সকল দিকে সমসত্ত্ব (homogeneous)। এখানে কায়াগুলো থাকে তবে কায়াগুলো স্থানকে অথবা স্থান কায়াগুলোকে কোনভাবেই প্রভাবিত করেনা। একইভাবে সময় হলো পরম যা কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। সময়ের তীর অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে বহমান। স্থান যেমন কায়ার আধার সময় তেমনি ঘটনার আধার । নিউটন আরো মনে করতেন স্থান ও কাল পরস্পরের উপর নির্ভরশীল নয়।

পক্ষান্তরে স্যার আইজাক নিউটনের ধারণা বা তত্ত্বের বিরোধী আর একটি ধারণা বা তত্ত্ব প্রতিস্ঠিত হয় এরিস্টটলের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে। এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করেন গটফ্রীড লেইবনিজ । এই ধারণা অনুযায়ী স্থান ও কাল বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বরং তার উপর নির্ভরশীল। স্থান হলো কিছু কায়ার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাল হলো কিছু ঘটনার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক । যেখানে কায়া নাই সেখানে স্থান নাই এবং যেখানে ঘটনা নাই সেখানে কাল নাই। মহাবিশ্বের আবির্ভাবের সাথে সাথে জন্ম হয়েছে স্থান ও কালের। আবার মহাবিশ্ব কোন দিন যদি তীরোভুত হয়ে যায়, তার সাথে সাথে স্থান ও কাল-ও তীরোভূত হবে।

এদিকে জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন যার আপেক্ষিকতত্ত্ব (Theory of Relativity) নামের বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা বিজ্ঞানের জগতে সূচনা করেছে এক নতুন যুগের, তিনি স্থান ও কাল সম্পর্কে দিয়েছেন আরো একটি নতুন ধারণা। পরবর্তি পর্বে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
(চলবে)


সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৩:৫৭
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×