somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্যালুট বদরুদ্দোজা স্যার, স্যালুট!

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৫:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



স্যালুট বদরুদ্দোজা স্যার, স্যালুট!
--------------- ড. রমিত আজাদ

১৯৮৩ সালের কোন একদিন, আমাদের ক্লাসরুমে এসে প্রবেশ করলেন সুঠামদেহী দীর্ঘকায় এক তরুণ অধ্যাপক, আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সাথে কথা বলে তিনি আমাদের মন কেড়ে নিলেন প্রথম দিনেই। নিজের বিষয় রসায়ন শাস্ত্র সহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান রাখা এই অধ্যাপক-এর নাম মোঃ বদরুদ্দোজা।

স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন গত পরশু দিন। গতকাল স্যারকে রেখে এলাম এক টুকরো জমিনের নীচে। স্যার, আমাদের জন্য আপনি অনেক কষ্ট করেছেন সারাজীবন, সবাই না জানলেও আমরা কেউ কেউ জানি। আমরা প্রতিদানে কিছুই দিতে পারিনি। আজ আপনি চলে গিয়েছেন তাঁর কাছে যিনি সবকিছু দেয়ার মালিক। দোয়া করি, আশা করি, প্রার্থনা করি, তিনি আপনাকে যথাযথ প্রতিদান দেবেন।

আত্মপ্রচার করার কোন প্রবণতা কখনো ছিলো না স্যারের মধ্যে। তাই নিজের কোন গৌরবময় অতীত বা গুণ নিয়ে কখনোই গর্ব করতেন না স্যার। একদিন ডরমিটরিতে বসে কথায় কথায় আমাকে বললেন যে, তিনি একবার হাটতে হাটতে ঘুমিয়েছিলেন। আমার বয়স তখন কম, নিতান্তই কিশোর, আবার স্যারের স্নেহ পেয়ে মাথায় উঠেছিলাম। বললাম, "হাঃ হাঃ হাঃ স্যার, এরকম হয় নাকি! কি যে বলেন! কোথায় হলো এটা?" স্যার বললেন, "১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময়।" এবার আমি কুঁকড়ে গেলাম! সেই ভয়াল দিনগুলোতে কত কষ্ট যে করেছিলো এদেশের মানুষ, তাতো পরিবারের মুরুব্বীদের কাছ থেকে শুনেছি। আমি বললাম, "কি ঘটেছিলো স্যার?" স্যার বললেন, "তিন দিন তিন রাত হেটেছিলাম। মাঝে মাঝে ক্লান্তিতে আর পারছিলাম না, শরীর ভেঙে ভেঙে পড়ছিলো। এরকম সময়ে হাটতে হাটতে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো।" প্রশ্ন করলাম, "এতো হেটেছিলেন কেন?" স্যার বললেন, "অস্ত্র আনতে গিয়েছিলাম, যুদ্ধের জন্য।" আবার প্রশ্ন করলাম, "আপনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?" স্যার ছোট করে বললেন, "হ্যাঁ।" আরো জানলাম যে, সেই সময় স্যার মাত্র ক্লাস ইলেভেন-এ পড়তেন। কিছুকাল পরে স্যারকে বলেছিলাম, "স্যার, আপনার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেখিয়ে তো কিছু সুযোগ সুবিধা পেতে পারেন" স্যার নিস্পৃহভাবে বললেন, "আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, কিন্তু কোন সার্টিফিকেট নেইনি।" এবার শ্রদ্ধায় নত হলাম আমি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ না করেই অনেকে অনেক হম্বি-তম্বী করে, কেউ কেউ ভুয়া সার্টিফিকেটও বাগায়, যেখানে স্যার মুক্তিযুদ্ধ করেও কোন ক্রেডিট নেয়ার কথা ভাবছেন না! স্যালুট!

আমাদের ক্লাস টিচার খুব ভালো মানুষ ছিলেন, ট্রান্সফার হয়ে গেলেন। আমরা মন খারাপ করলাম, কিন্তু মন খারাপ স্থায়ী হলোনা, বদরুদ্দোজা স্যার আমাদের ক্লাস টিচার হলেন। আমরা সবাই খুব খুশী হলাম। একজন ভালো মানুষ গিয়ে আরেকজন ভালো মানুষ এলেন। স্যার বললেন, "ক্লাসরুম খুব সুন্দর করে সাজাতে হবে, যেন সবার তাক লেগে যায়।" কোথা থেকে যেন স্যার জোগাড় করে আনলেন চমৎকার কিছু পোস্টার। এত সুন্দর ফুল-প্রকৃতির ছবিওয়ালা পোস্টার আগে কখনো দেখিনি। তাই দিয়ে সাজিয়ে দিলাম ক্লাসরুমের ডিসপ্লে বোর্ড। সত্যিই তাক লেগে সবার। রুচিশীল মানুষ বদরুদ্দোজা স্যার বললেন, "শোন শুধু ডিসপ্লে বোর্ড নয়, ব্লাক বোর্ডেও সৌন্দর্য্যবোধ থাকতে হবে, কেউ একজন স্টেটমেন্ট-এর পাশে সুন্দর বর্ডার এঁকে দেবে চক দিয়ে।" আমি ফুল-পাতার কম্বিনেশনে একটা বর্ডার আঁকলাম। পরদিন ওটা দেখে পছন্দ হলো স্যারের। কয়েকদিন পর আমি ভাবলাম এই বর্ডারটা পুরনো হয়ে গেছে, মুছে ফেলি, আরেকটা আঁকবো। মুছে ফেলার পর স্যার ঢুকলেন ক্লাসে, কোন বর্ডার নাই দেখে বিরক্ত হলেন, "কে মুছেছে বর্ডার?" আমি ইতস্তত করে বললাম, "জ্বী, আমি স্যার।" স্যার বললেন, "চট করে মুছে ফেললে! যে এঁকেছিলো সুন্দর এঁকেছিলো, তুমি ওরকম আরেকটা আঁকতে পারবে?" এবার, খুশী হয়ে আমি বললাম, "আগেরটা আমিই এঁকেছিলাম স্যার।" স্নেহশীল স্যার হেসে ফেললেন, বললেন, "গুড, এবার ওরকমই সুন্দর আরেকটা আঁকো।"

ক্লাবস এন্ড সোসাইটি-তে স্যার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ফটোগ্রাফী ক্লাবের। সেই সময় ক্যামেরা খুব দামী ও দুর্লভ যন্ত্র ছিলো। কিন্তু সৌখীন স্যার দুইটি ক্যামেরা কিনেছিলেন। তাই দিয়ে ছাত্রদের ফটোগ্রাফী শিখাতেন। আমার এখনো মনে আছে, আমি ফটোগ্রাফী ক্লাবের সদস্য না হলেও স্যার আমাকে হাতে ধরে ধরে ছবি তোলা শিখিয়েছিলেন। স্যারের ছবি তোলার হাত ছিলো অসাধারণ! সেই সময়ে প্রজেক্টরের জন্য স্লাইড ছবি তোলা বিষয়টি ছিলো খুবই রেয়ার। অথচ স্যার সেই ছবিও চমৎকার তুলেছিলেন। অডিটোরিয়ামে একটি নাটকের মঞ্চায়নে আমাদের অভিনেতাদের ছবি স্লাইড প্রজেক্টরে দেখিয়ে তাক লাগিয়েছিলেন।

কলেজের প্রজেক্টরটি অকেজো হয়ে পড়ে ছিলো। আমরা বঞ্চিত হচ্ছিলাম সিনেমা দেখা থেকে। বদরুদ্দোজা স্যার উদ্যোগ নিলেন। প্রিন্সিপালকে বলে কয়ে প্রজেক্টরটি ঠিক করলেন। প্রজেক্টরতো ঠিক হলো, কিন্তু শো করতে হলেও টাকা লাগে। সরকারের বাজেট কম ছিলো, সিনেমা খাতে বোধহয় টাকা পাওয়া যাচ্ছিলো না। স্যার তাঁর ব্যাক্তিগত কানেকশনে কোথা থেকে যেন ফিল্ম নিয়ে এলেন। প্রথম যেই ছবিটি দেখালেন, উত্তম কুমার অভিনিত সেই ছবিটির নাম 'সবার উপরে'। ছবিটি দেখে এতো মুগ্ধ হয়েছিলাম সবাই যে বহু বছর মনে রেখেছিলাম। পরবর্তি যে ছবিটি দেখিয়েছিলেন তার নাম ছিলো 'ওগো বধু সুন্দরী'। আমাদের সেই বয়সে এমন কমেডী সিনেমা দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম। একজন তো বললো। "অস্কার পাওয়া ছবি দেখলেও বোধহয় এতো মজা পেতাম না।" বছর দুয়েক পরে আমার এক ক্লাসমেট আমাকে তিরষ্কার করে বলেছিলো, "সিনেমার আয়োজন করিস, কই বদরুদ্দোজা স্যারের মতো ছবি তো দেখাতে পারিস না!"

একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মাঠে গিয়ে হতবাক হলাম। মাঠের অনেক উপরে প্রায় মেঘের কাছাকাছি জ্বলজ্বল করে উড়ছে ব্যানার, 'বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সিলেট ক্যাডেট কলেজ, .........................।' তার উপরে লাল-নীল ইত্যাদি রঙের বিশালাকৃতির কয়েকটি বেলুন। অমন বেলুন আমরা আগে কখনো দেখিনি। সবার মনে প্রশ্ন, 'কে করলো, এমন চমৎকার আয়োজন?' আর কে? আমাদের বদরুদ্দোজা স্যার। ছুটে গেলাম স্যারের কাছে, "স্যার, কি চমৎকার আইডিয়া! কোথায় পেলেন এমন বেলুন?" স্যার মুচকি হাসলেন কেবল। পরে জেনেছিলেন, এটাও স্যার ব্যাক্তিগত উদ্যোগেই করেছিলেন।

স্যার নিজে যেমন হাসিখুশী ছিলেন, হাস্য-রসিকতাকেও স্যার খুব ভালোভাবে নিতেন। একবার স্যার বললেন, " তোমাদের এখানে ডিসপ্লে বোর্ড পিছনে, আমাদের সময় ছিলো সামনে।" আমি বললাম, "জ্বী, জ্বী, আপনাদের সময় ডিসপ্লে বোর্ড ছিলো সামনে, আর ব্ল্যাক বোর্ড ছিলো পিছনে।" ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আমি ভাবলাম, স্যার আবার রেগেই যান কিনা! কিন্তু না স্যারও হেসে উঠলেন। স্যার মাঝে মাঝে চমৎকার কৌতুক বলতেন, একটি উল্লেখ করছি - একবার কলেজের প্রিন্সিপাল রেগে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলছেন, "স্টুডেন্টস, ইউ কান্ট স্পীক ইংলিশ ওয়েল, দিস ইজ নট এ্যাকসেপ্টেবল। ডু ইউ নো, হোয়েন আই ওয়াজ লাইক ইউ, আই কুড স্পীক, এ্যাজ আই স্পীক নাউ'। এই কথা শুনে এক ছাত্র পিছন থেকে বলে, 'ইয়েস স্যার, দেন নো ইমপ্রুভমেন্ট!' একবার একটি ইংরেজী ছবিতে চুম্বন দৃশ্য চলে এলো, সেই সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেটা দেখানোর রীতি ছিলো না। স্যার হাত দিয়ে প্রজেক্টরের লেন্স ঢেকে দিলেন। সেই উঠতি বয়সে আমরা তো হায় আফসোস, এরকম একটা দৃশ্য দেখতে পেলাম না। পরদিন ক্লাসরুমে একজন বললো, "স্যার সিনেমাটা ভালো দেখিয়েছেন। আপনাকে ধন্যবাদ। তবে ঐ দৃশ্যে হস্তক্ষেপ না করলেও পারতেন।" আমরা সবাই কোরাসে হাসলাম। স্যারও মুচকি হাসলেন। স্যার বিজ্ঞানের নানা প্রজেক্ট করতে জানতেন। একবার আমাদের বললেন যে, তিনি একটি চোর ধরার মেশিন তৈরী করেছিলেন। আমি স্যারের কথা বিশ্বাস করলাম না, বললাম, "জ্বী, তারপর সেই মেশিনটা চোরে নিয়ে গিয়েছে, তাই না স্যার?" স্যার রাগ না করে, হাসলেন। তারপর সেই মেশিনের মেকানিজম আমাকে বোঝালেন। সব শুনে আমি তো তাজ্জব! ইলেকট্রনিক আই বিষয়টি স্যারের কাছ থেকেই প্রথম শিখলাম। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে অধ্যায়নকালীন সময়ে একটা টেলিফোন তৈরী করে প্রিন্সিপালের টেলিফোনের তারের সাথে কানেকশন লাগিয়ে কেমন আড়ি পেতে কথা শুনেছিলেন সেই কথা একদিন বললেন। স্যারের ক্রিয়েটিভিটি, সাহসীকতা ও রসবোধ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না, বললাম, "স্যার আপনিও তাহলে ছোটবেলায় দুষ্টামী করেছেন।" স্যার লাজুক হাসলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন বন্ধু-বান্ধবরা কেমন হাসি ঠাট্টা মজা করতেন তার কিছু বর্ণনা করেছিলেন। শুনে তো আমরা হাসতে হাসতে শেষ। স্যারের রসবোধ এখনও আমাকে সিক্ত করে।

স্যার খেলাধুলায়ও বেশ পারদর্শী ছিলেন যেমন ভালো খেলতেন ক্রিকেট তেমনি ভালো খেলতেন হকি। আমাদের শিখাতেন খেলতে। কলেজের ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় আম্পায়ারিং করতেন চমৎকার!

কেমিস্ট্রি ল্যাবে মজার মজার সব এক্সপেরিমেন্ট দেখাতেন আমাদের স্যার। একবার নিয়ে এলেন 'ফেরাউনস স্নেক'। তারাবাতির মত একটা স্টিক দেখিয়ে বললেন, "এটা কি?" আমরা বললাম, "জানিনা স্যার, তারাবাতির মত লাগে।" স্যার বললেন, "এটা ফেরাউনস স্নেক।" আমরা বলি, "এই বাংলাদেশে সাপ আছে, এখন আপনি কি দেখাবেন দেখি।" স্যার ঐ স্টিকটির মাথায় আগুন জ্বালালেন, ওমা ওখান থেকে সাপের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কি যেন বেরিয়ে এলো! আমরা সাধুবাদ দিলাম স্যারকে।

একদিন প্রশ্ন করলাম, "স্যার বন্দুক চালানো প্রথম শিখেছিলেন কবে? যুদ্ধে?" স্যার বললেন না তার আগেই, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময়ই। এনসিও-রা আমাদের হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে বলতো, "চার্জ-উইথড্র, চার্জ-উইথড্র" এরকম করতে করতে হাত ব্যাথা হয়ে যেত। বুঝলাম কঠোর প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন স্যার, এটাই পরবর্তিতে দেশ-মাতৃকার সেবায় কাজে লাগিয়েছিলেন।

একবার কালচারাল অনুষ্ঠানের আগে ডরমিটরিতে বসে আমরা রিহার্সাল দিচ্ছিলাম। স্যার প্রবেশ করলেন। হারমোনিয়াম হাতে নিলেন। আমরা অবাক হয়ে ভাবছি এরপর কি করেন দেখি। স্যার অদ্ভুত সুরে বাজাতে শুরু করলেন হারমোনিয়াম। তারপর শুনলাম উনার সুরেলা কন্ঠের গান। আমাদের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, "হোয়াও!" এরপর থেকে যেকোন অনুষ্ঠানে আর ছাড়াছাড়ি নেই, স্যারকে বাধ্য করতাম গান গাইতে। একটি গান স্যার গাইতেন চমৎকার, "আমি রই পথেরও ধুলায়, .............. মোর মরণ হলেও কভু জড়িয়ে আমায় কেউ কাঁদবে না।" গানটির সুর এতো হার্ট-টাচিং ছিলো যে, চোখ থেকে অটোমেটিক পানি বেরিয়ে আসতো।

আমাদের দেশে শিক্ষকরা অর্থনৈতিকভাবে এখন যেমনি দুর্বল, তখনো তেমনি ছিলো। একদিন শীতের রাতে স্যার এলেন সুন্দর একটা কোট গায়ে দিয়ে। সুঠাম দেহী টল ফিগারের স্যারকে চমৎকার লাগছিলো। আমি বললাম, "আপনাকে চমৎকার লাগছে স্যার! এতো দামী কোট গায়ে দিয়ে এসেছেন! স্যার আপনি তো বড়লোক!" স্যার আমাকে কোটের ভিতরের অংশ দেখালেন, বুঝলাম গুলিস্তান থেকে কেনা। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আরেকদিন স্যার বললেন, "আমার ছোট ভাইটা ব্যবসা করে। ও বাড়ীতে ভালো টাকা-পয়সা দিতে পারে, আমি অত দিতে পারিনা!" এই স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইউসুফ আলী (পরবর্তিকালীন উপাচার্য) স্যারের প্রিয় ছাত্রদের একজন ছিলেন। আউটস্ট্যান্ডিং পারফর্মেন্স-এর জন্য স্বয়ং রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরযুক্ত সনদ পেয়েছিলেন। অথচ অধ্যাপনা পেশা বেছে নেয়ার জন্য আর্থিক কষ্ট করছেন।

একদিন শুনলাম স্যারের বিয়ে। ঐ বয়সে মজা পেলাম সংবাদ শুনে। কয়েকদিন পরে স্যার এলেন, তিনি আর একা নন। ম্যাডামের দিকে তাকালাম আমরা, প্লিজেন্ট পার্সোনালিটি! জানলাম তিনিও শিক্ষিকা। ভালো লাগলো আমাদের সবার। আমাদের ক্লাসের কালচারাল ফাংশনে স্যার ও ম্যাডাম দুইজনই উপস্থিত হলেন। মাতৃসুলভ ম্যাডাম-কে দেখে সবাই অনুপ্রাণিত হলাম। ঐ ফাংশনটি বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। কিছুকাল পরে উনাদের ঘর আলো করে এলো উনাদের প্রথম সন্তান। পিতৃসুলভ স্যারের কোলে সন্তান খুব ভালো থাকতো। গুটি গুটি চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো শিশুটি। "স্যার, ছেলের নাম কি রেখেছেন?" স্যার বললেন, "নিলয়"। ঐ নিলয় নামটিই আমার মনে গেঁথে আছে। যদিও আজ সে মেজর সেলিম নামে বেশী পরিচিত।

তারপর স্যার ট্রান্সফার হয়ে গেলেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। আমাদের ওখানকার ব্যাচমেটদের কাছ থেকে স্যারের খোঁজ পেতাম। সবাই প্রশংসা করতো স্যারের।

অনেক অনেকগুলো বছর পরে, আমি নিজেই তখন অধ্যাপক। আমার টেলিফোনে শুনতে পেলাম একটি পরিচিত কন্ঠস্বর, "রমিত কেমন আছো?" জানতে চাইলাম, "জ্বী, কে বলছেন?"
: আমি তোমার বদরুদ্দোজা স্যার।
তড়াক করে উঠলাম। এতোগুলো বছর হয়ে গেছে, স্যার আমাকে ভোলেননি?
:স্যার, আসসালামু আলাইকুম। আপনি স্যার, কেমন আছেন? কোথায় আছেন? একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম।
স্যার একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন, বললেন
: আমি তো এখন তোমাদের কলেজেরই ভাইস-প্রিন্সিপাল।
এটা আমার জন্য সুখের সংবাদ ছিলো। এতো গুণী ও ভালো একজন মানুষ আমার কলেজেরই ভাইস-প্রিন্সিপাল, এটা আমার জন্যে গর্বের বিষয়।
এত গুণী একজন মানুষ, আমার ফোন নাম্বার তালাশ করে ফোন করেছেন, একদিকে ভালো লাগলো, আরেক দিকে লজ্জ্বা লাগলো, আমারই তো উচিৎ ছিলো স্যারকে ফোন করা। বললাম, "স্যার, সরি আমি আপনার ফোন নাম্বার জানতাম না, তাই খোঁজ নিতে পারিনি।"
স্যার বললেন, "আরে না না, নো প্রবলেম।"
এরপর থেকে স্যারের সাথে যোগাযোগ আর বিচ্ছিন্ন হয়নি। ২০১১ সালে আমাদের কলেজের রি-ইউনিয়নে গেলাম। স্যার তখন সদ্য রিটায়ার করেছেন। স্যারও যোগ দিলেন রি-ইউনিয়নে। পুরো তিনদিন সুযোগ পেলাম স্যারের কাছাকাছি থাকার। আমাদের ব্যাচের সবাই সেই পুরাতন ক্লাস-টিচারের সাথে থাকতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করলো।

রিটায়ার করার পর শ্রীমঙ্গলের একটি কলেজে কিছুদিন ছিলেন স্যার। সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকায় চলে আসবেন। স্যারের স্ত্রী ছিলেন রংপুরে কর্মরত। প্রয়োজন ছিলো ম্যাডামকে ঢাকায় ট্রান্সফার করার। স্যারের ছেলের মুখে শুনলাম, স্যার চিরটাকাল কষ্ট করেছেন। স্যার এক জায়গা্য কর্মরত, উনার স্ত্রী ভিন্ন জায়গায় কর্মরত ছিলেন। এত কষ্টের মধ্যেও স্যার কখনো কর্তব্যে অবহেলা করেননি।

গত অক্টোবরে আবারো রি-ইউনিয়ন হলো সিলেট ক্যাডেট কলেজে। স্যার অসুস্থ ছিলেন, এই অসুস্থতার মধ্যেই স্যার ছুটে গেলেন তার প্রিয় ছাত্রদের কাছে। এই কলেজের সাথে জড়িয়ে আছে স্যারের চাকুরী জীবনের প্রথম দিককার স্মৃতি, স্যারের বিয়ে ও প্রথম সন্তান জন্মের স্মৃতি, পরিশেষে ঐ কলেজ থেকেই উপাধ্যক্ষ হিসাবে অবসর গ্রহণের স্মৃতি, তাই কলেজের রি-ইউনিয়ন এড়াতে পারেননি তিনি। সেখানে স্যার অভুতপূর্ব স্টেজ পারফর্মেন্স করলেন, প্যারোডি গান গেয়ে মুগ্ধ করলেন সবাইকে।

শেষ পর্যন্ত ম্যাডামের ট্রান্সফার ঢাকায় হয়েছিলো। স্যারও চলে এলেন ঢাকায়। স্যারের ছেলের পোস্টিং ঢাকায়, মেয়েটি আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। পুরো পরিবারটি যখন একত্রিত হলো, ঠিক তখনই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন স্যার।

গতকাল ঢাকা সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে স্যারের নামাজে জানাজা হলো। মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করতেই দেখলাম মিজানুর রহমান কলি ভাই (চেয়ারম্যন মানবাধিকার কমিশন) দাঁড়িয়ে আছেন। উনি আমার পূর্ব-পরিচিত, কথা বলে জানলাম কলেজে স্যারের এক বছরের জুনিয়র ছিলেন তিনি। সামরিক পোশাকে অনেক পদস্থ কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, বুঝলাম উনারা স্যারের ছাত্ররা। বেসামরিক ছাত্ররাও এসেছিলো অনেক। আরো এসেছিলেন স্যারের কলিগরা। অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।

জানাজার পর সামরিক লড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর সেনানিবাস গোরস্থানে। সেখানে যথাযোগ্য মর্যাদায় দাফন করা হয় দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক মো. বদরুদ্দোজা স্যারকে। চোখের সামনে ধীরে ধীরে মাটির কোলে ঘুমিয়ে গেলেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক।

স্যারের নিজ কন্ঠে গাওয়া গানটি মনে পড়লো, "আমি রই পথেরও ধুলায়, .............. মোর মরণ হলেও কভু, জড়িয়ে আমায় কেউ কাঁদবে না।" না স্যার, আমরা কেঁদেছি, আমরা কাঁদবো, যতদিন বেঁচে থাকবো আপনার কথা মনে হলেই চোখ ছলছল করে উঠবে।

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৫:০১
১১টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×