রায়হান, আমার প্রতিবেশী কুসুম ভাবীর ছেলে। কত হবে আর বয়স, দুই কি আড়াই। ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চাটাকে নিয়ে তার বাবা মা ছোট্ট একটা একরুমের বাসায় থাকে। ভাড়া মাত্র তিন হাজার টাকা। রায়হানের বাবা কোন একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী করেন। বেতন খুব বেশী হয়ে সাত কি আট হাজার টাকা পান। কোন মতে দিন যায় রাত আসে। তিন বেলা দু'মুঠো ভাত খেতে পারে এতেই তারা খুশী। তবে যতই কষ্ট হোক না কেন বাচ্চাকে বুঝতে দেন না। রায়হানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন নাই ওর মা। তাই ছোট বেলা থেকেই ফিডার খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গরুর দুধে অনেক দাম, তাই রায়হানের মা কৌটার দুধ কিনে বাচ্চাকে খাওয়ান। নেশা কথাটা বাচ্চার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তার বাস্তব প্রমান রায়হান। সময় হলেই খুধার টানে ঠিকই দুধ খুঁজতে থাকে। মুখের ভিতর ফিডার দিলেই চুপ হয়ে যায় রায়হান। মায়ের চোখে মুখে তখন আনন্দের বন্যা ঝিলিক মারে। নিজেরা ভাল মন্দ না খেতে পারলে কি হবে; বাচ্চাটা যে পেট ভরে দুধ খেতে পাচ্ছে এটাই রায়হানের মা-বাবার সান্তনা।
ওরা এই বাড়িতে উঠেছে বছর খানেক হল। হঠাৎ করে রায়হানের বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকদিন অফিসে যেতে পারছেনা। অসুখের কথা অফিসে জানানো হয়েছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ ভীষন নারাজ। কথায় বলে কপাল যখন খারাপ হয় চারিদিক থেকেই হয়। অফিস থেকে ফোন করে জানিয়ে দিল সামনের মাস থেকে আর আপনাকে আসতে হবে না।
রায়হানের বাবা যেন হার্টফেল করলেন খবরটা শুনে। চোখে ঘোর অন্ধকার দেখতে লাগলেন। তার পরেও তার রয়েছে আল্লাহর উপর ভরসা। রিযিকের মালিক আল্লাহ, তিনিই আমাদের দেখবেন। রাজ্যের হতাশা রায়হানের চোখে মুখে।
রাতের বেলা বাড়িওয়ালার শুভাগমন। তার দাবী এক বছরতো হল, এবার ভাড়া বাড়াতে হবে ১০০০.০০ টাকা। আশপাশের সবার বাড়ি ভাড়া বেড়েছে, শুধু আমিই বাড়াইনি। এই ধরনের বাসা ভাড়া আশ পাশে পাঁচ হাজার টাকার কম নয়। শুশু আমিই তিন হাজার টাকায় ভাড়া দেই। তবে এবার একহাজার টাকা বাড়াতে হবে।
'যেন মড়ার উপর খাড়ার ঘা'। চাকরী নাই তা বললে বাসা ছেড়ে দিতে বলবে এতে সন্দেহ নাই। অনেক দর কষা কষির পর ৫০০.০০ টাকায় এসে বাড়িওয়ালা রাজী হলেন। এভাবে একমাস চলার পর রায়হানের পরিবার চরম অভাবে পতিত হলো। ভাবীর মুখের দিকে তাকাতে পারি না।
সেদিন সন্ধায় ওদের ঘরে গেলাম, বাচ্চাটা দুধ খাওয়ার জন্য কাঁদছে। ওর মাকে দেখলাম ভাতের মাড় ফিডারে ঢুকিয়ে বাচ্চাটাকে দিল। অবুঝ শিশু তাতেই খুশী। মায়ের চোখের কোন পানি, আমাকে দেখে তা লুকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল।
কাঁদছ কেন ভাবী, জিজ্ঞেসা করতেই হাউ মাউ করে বুকের মাঝে জমে থাকা কষ্ট যেন উফছে পড়তে লাগল। আমিও সান্তনা দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
মায়ের আহাজারী, আমার রায়হানকে দুধের বদলে ফ্যান খাওয়াই। বাড়িওয়ালাকে কত অনুনয় করলাম, ভাড়াটা না বাড়ানোর জন্য। শুনল না, রায়হানের বাবা অফিসে গিয়ে স্যারদের পা' পর্যন্ত ধরেছে চাকরীটা ফেরত পাবার জন্য। কিন্তু ফেরত পায় নাই। কি হইবো আমার বাচ্চাটার!!!
আমার বুকের মাঝে গুলিয়ে উঠল কথাটা শোনার পর। দুধের পরিবর্তে ভাতের মাড়!!
এমন নির্দয় কেন মানুষ? এই প্রশ্ন সারাক্ষন আমার মনের মাঝে ঘুর পাক খায়।