বাড্ডা, জগন্নাথপুরের আব্দুল আজিজ রোডের একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়ালাম। একটু ঘুরে তার দেয়া তথ্য মতে পুরো অফ হোয়াইট রঙের এই ছয়তলা বাড়িটিকেই মনে হলো সেই বাড়ি। সামনে বসুন্ধরা হলি কেয়ার স্কুল। সারিবাধা দোকান। আমার খুব আনন্দ হলো। এ বাড়ির চারতলায় বিথী এসেছে। আমি বিথীকে চার বছর ধরে চিনি। না ঠিক চিনি না। কথা বলি। চিঠি লিখি। একটা পত্রিকায় লেখালেখির সূত্র ধরে আমাকে অনেকে চিঠি লিখতো। বিথীও ছিলো তাদের মধ্যে। তাৎক্ষণিক আবেগের সে সব পাঠক হারিয়ে গেলেও বিথী তার আন্তবিকতায় বন্ধুত্ব তখনও রেখেছিলো। তা না হলে আমার বেহিসেবি বৈরিতায় অনেক আগেই এ সম্পর্ক হারিয়ে যেতো। বিথির সাথে ফোনে কথা বলি। আমার অস্থির মনেও বিথী হয়ে উঠেছে আদর্শ মেয়ের মূর্তি। যদিও কোনদিন তারে দেখিনি। তার কণ্ঠ মাধুর্য ছুঁয়ে কেবল সময় বয়ে গেছে। বিথী ঝালকাঠি থেকে ঢাকা এসেছে। ফোনে তার ঠিকানা জানালো। আমাকে সে দেখবে। আমিও বুঝি বিথীকে দেখতে চাই। জীবনটাকে আমি যেন কেমন করে ফেলেছি। তুচ্ছ লেখাগুলো পড়ে সবাই আমাকে গুলিয়ে ফেলে। বলে প্রেমেই ডুবে আছি সারাক্ষণ। কিন্তু সুহৃদ ও নারী স্পর্শহীন আত্মমগ্নতার যে জীবন সাজিয়েছি তাতে অজান্তেই জমে উঠেছে শূন্যতা। তাই হয়তো বিস্তৃত কল্পনায় বাইশ বসন্তের রং খুজি।
হয়তো একটু আগ্রহ নিয়েই বিথীর কাছে গেলাম। একটু দূরে আড়ালে দাড়িয়ে ফোন দিলাম ‘হ্যালো বিথী কি করছো’। এই তো বাসায়’। তখনই দুইটা যুদ্ধ বিমান উড়ে গেল। বিথী যুদ্ধ বিমান যাচ্ছে বুঝি। ‘হ্যাঁ’ তোমাদের বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার পূর্ব দিকে জানালার পাশে অনেকগুলো ফুলের টব না’। বিথী এবার অস্থির পায়ে জানালায় তারপর বারান্দায় দাড়ায়।
আমি- বলি বারান্দায় দাড়িয়েছো না।
-তুমি কোথায়
-এই তো তোমার পাশে।
-বলতো আমার পাশে কি?
-একটা নীল চেয়ার।
-তুমি বাড়ির সামনে আসো তোমাকে দেখবো।
-তুমি রাস্তার পূর্ব দিকে তাকাও আসি আমি আসছি।
আমি হেটে গিয়ে বাড়ির সামনে দাড়ালাম। বিথী চার তলার বাড়ান্দায় দাড়িয়ে। আমি লজ্জা কিংবা অনভ্যস্ততায় উপরে বিথীর দিকে তাকতে পারি না।
খানিক পর বিথী ফোন দেয়-তুমি চলে যাও। আমি নিচে আসতে পারবো না। বাসায়ও তোমাকে আনা যাবে না, সবাই খারাপ ভাববে। আর বারান্দায়ও বেশিক্ষণ দাড়ানো ঠিক হবে না। আমি এক ঝলক উপরে তাকালাম। গড়নটা তার ঠিক বোঝা হয়নি। কিংবা আমি বুঝতেও চাইনি। আবার সে বললো তুমি চলে যাও। ফোনটা নামিয়ে রাখি। চৈত্রের তীব্র রোদে হাটতে থাকি। আর মন হিসেবে বসে গেছে। চারটা বছরের জানা-শোনা। কোনদিন দেখিনি। আজ এই দুয়ারে এসে দাড়িয়েছি। নিচে নেমে এসে বন্ধুর সামনে দাড়ানোর কিংবা ঘরে তোলার বাঁধটুকু সে পেরোতে পারে না।
চৈত্রের উথাল-পাথাল বাতাসে দেদার ধুলো ওড়ে। আমার চুল, ত্বকে জমতে থাকে সেই ধুলো। বন্ধুর দাওয়াতে এসেছি। এখানকার অতিথি আমি। এসেই কি চলে যাওয়া যায়! কাছের একটা দোকানে বসি। মনে হয় কতো তীব্র আকাঙ্খায় বিথীকে দেখতে চেয়েছি আসার আগে তা বুঝিনি। আবারো বিথীর ফোন-বাসায় চলে যাও। বিথীর হয়তো আমাকে দেখতে ভালো লাগছে না। আমি ততো সুদর্শনও নই।
কিন্তু পাগলামি কিংবা অভিমানে আমি আজ বাড়ি ফিরবো না। জোহরের নামাজের পর পাশের মসজিদের নরম কার্পেটের উপরই শুয়ে পড়ি। পেটে প্রচণ্ড খিদে। পকেটে মাত্র ১১ টাকা। বাসায় ফিরতেই লাগবে এটা। টিউশনির টাকা পাইনি তখনো। বিথীকে ফোন দেই। ফোন বন্ধ। হয়তো বিরক্ত হচ্ছে। অনেকক্ষণ পর পাওয়া যায়। আমি বলি বিথী খুব খিদে লেগেছে। বিথী হাসাতে হাসতেই বলে, আমি ভাত খাচ্ছি। খাইবা তুমি। হায়! আমার ুধার সাথেও যেন বিথীর নির্মম ঠাট্টা হয়ে যায়। আজ তোমার অতিথি হয়েছি। ঘরে তোলনি। রোদে পুড়িয়েছো। আমার মনটার দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা কি দিয়েছ একটু। কি যে হয় আমার। দু’চোখ বেয়ে কষ্টের ধারা নামে। সেই নির্জন মসজিদটার মধ্যে ব্যথায় খুন হয়ে যাই। পৃথিবীর কোন মন তা স্পর্শ করতে পারে না।
ফের রাস্তায় নেমে আসি। রোদ তাপ তখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে। কষ্ট যখন নেবো পুরোটাই নেবো।
বিকেল নেমেছে। যেতে যেতে শেষ বারের মতো চার তলায় চোখ রাখলাম। জানালা, বারান্দায় কেউ নেই। পেছনের বারান্দায় শুকোতে দেয়া কাপড় দুরন্ত বাতাসে উড়ছে।
এত দিনের জানাশোনা সব যেন পরিহাস। হায়! গাঙচিল মন। তার ঠিক শিক্ষাই হলো।
এবার ফোন বিথীই করে। আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এক দুপুরেই যেন ফুরিয়ে গেছি।
মাসুদ তুমি কোথায়, বলে বিথী।
বলি, এই তো আছি।
প্লিজ পাগলামি কইরো না। বাসায় যাও। আর আমি খুব দুঃখিত।
আবার দু’চোখে ঝাপসা দেখতে থাকি। জানালা, বারান্দা এমনকি পুরো বাড়িটা দৃষ্টিতে ভেঙ্গেচুড়ে গিয়ে টপটপ করে ঝরতে থাকে। বিথী তার কিছুই দেখে না। হয়তো খাটের উপর আরাম করে শুয়ে কথা বলছে। ফোনে কথা বলা হচ্ছে অন্ধকারে অসম্পূর্ণ ভাব-প্রকাশ। এতে ধরা পড়ে না চোখের তারার চঞ্চল কাঁপন, আনন্দ বেদনায় মুখের অকৃত্রিম ভঙ্গিখানি। তবে আর ভাবের আদান-প্রদান কি। এই যে রুমালে দু’চোখ ঢেকে কানে ফোন ঠেকিয়ে ভেঙেচুরে যাচ্ছি তার খবর হয়তো ও প্রান্তের বিথীর কাছে নেই।
-রানা মুহম্মদ মাসুদ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




