২৭ জুন ২০১০
প্রথম হরতাল। ঠিক দশটায়ই বাসা থেকে বের হলাম। রাস্তায় এসেই অবাক। পূর্ব-পশ্চিম মুখী রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত সব স্পষ্ট। খুব ভালো লাগালো। একটু দাড়াতেই বাসও একটা পেয়ে গেলাম। আবার অবাক হলাম রায়েরবাগ থেকে মাত্র ১০ মিনিটে জয়কালি মন্দির মোড়। প্রতিদিন পৌঁনে এক ঘণ্টায় আসতে অভ্যস্ত। সেখানে মাত্র ১০ মিনিট, নামতে ইচ্ছে করছিলো না। আজ ঝুঝি ৫ টাকা ভাড়ায় পোষাইলো না! বাস থেকে নামতে নামতে এক জন কথাটি বলেও ফেললো।
জয়কালি মন্দির থেকে সচিবালয় ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো হরতাল বুঝি একটু পালিতই হচ্ছে। সচিবালয়ের সামনে ব্যাপক নিরাপত্তা। দুটি গেটের সামনেই অসংখ্য পুলিশ। ভেতরে ঢুকে একটু অন্যরকম মনে হলো। কেমন ফাঁকা ফাঁকা। যথারীতি ঢুকে আমাদের বিখ্যাত সেই কাঁঠাল তলাতেই। কাছেই দেখি এটিএন নিউজের শুকা আপু ৬নম্বর ভবন থেকে নামা শিক্ষা সচিবের সাথে কি যেন বলছেন। কে জানে কি নিউজ নিচ্ছেন। দৌড়ে গেলাম। গিয়ে আপুর পাশে দাড়ালাম। না তেমন কিছু না। স্যার বললেন খবর কি? বলেই গাড়িতে বেড়িয়ে গেলেন স্যার। আশেপাশে আর কাউকে দেখছি না সব গেল কই? আপু বললো চল, টুকুকে (স্বারাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু) ধরি। কাউরে কইবি না। দেখলাম তখন পর্যন্ত মির্জা আব্বাসসহ অনেক বিএনপি নেতাই গ্রেফতার হয়েছেন। বললাম, চলেন। ভিজিটিং কার্ড দিতেই সাথে সাথে অনুমতি। ধর-পাকড় নিয়ে মন্তব্য নিলাম। এছাড়াও মন্ত্রী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সোনার বাংলা, বীর বাঙ্গালি নিয়ে বক্তব্য দিয়ে আধা ঘণ্টা আটকে রাখলো। বেরিয়েই অফিসকে জানালাম। ল্যাপটপ বের করে দ্রুত লিখে অফিসকে দিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে আপলোড। সবাই জেনে গেল, আমরা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। এবিসি’র শারমিন আপু ফোন দিলেন। সত্যি বলতে তার ভয়ে ছিলাম। ‘কিরে টুকুর সাথে কথা বলছিস’ ‘না না হ্যাঁ বলেছি।’ ‘আমাকে ডাকিসনি কেন’ বলেই ঠাস করে কেটে দিলেন। বুঝলাম আজ তার সামনে পড়া যাবে না।
কিন্তু ঠিকই পড়ে গেলাম। একেবাবে প্রথম আলোর রোজিনা আপুসহ। দুজনেই ব্যাপক মারমুখী। অবস্থা বেগতিক দেখে বল্লাম- আর কোনদিন এমন করবো। মাফ চাই। ‘এখন বল টুকু কি কইছে’। এই দুইটা আপু আমার অনেক প্রিয়। চ্যানেল আইয়ের রিয়াটাও অনেক প্রিয়। দুপুরের দিকে ৬ নং ভবনের ক্যান্টিনে সাংবাদিকদের তুমুল আড্ডা জমে গেল। বিডি নিউজের প্রিয় লেবু ভাই, আমাদের সময়ের মিথুন ভাই, করতোয়ার আমাদের সবার প্রিয় মোতাহার ভাই, কালের কন্ঠের জুয়েল ভাই, বাংলা নিউজের বাদল ভাই। সব সময় দেরি করে আসা একুশে টিভির মাহাথির ভাই আমাকে দেখে বার বার বললো- সবার আগে আইছে রে রানা। দেরি করার অপবাদ ঘুচাইয়া দিমু। কালো মেঘ করে বৃষ্টিও হলো এক পশলা। ডান্ডা পার্টি (চ্যানেলের সাংবাদিকরা) ততক্ষনে নিউজ নিয়ে অফিসে ছুট।
কোন প্রোগ্রাম নেই এক এক করে সবাই চলে যায়। প্রতিদিন আমি একেবারে সবার পরে ফিরি। চারটার দিকে দেখি পুরো সচিবালয় কেমন নিস্তব্ধ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতির কমতি নেই। এদিনে সৈয়দ আশরাফ (মন্ত্রীদের মধ্যে তিনিই বোধহয় সবচেয়ে কম অফিস করেন) যেখানে এসেছেন, সেখানে উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে না। হেঁটে হেঁটে দেখি। পূর্ত, আইন মন্ত্রণালয়ের দিকটা একেবারে ফাঁকা। গাড়ির জট নেই। নেই কোলাহল। আসলে আজ কোন দর্শনার্থী নেই। ভাবি দর্শনার্থী বিহীন কেমন অশোভন স্তব্ধতা ডেকে দিয়েছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সামনে রঙ্গনের ঝাড় বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যেন আরো রক্তিম হয়ে উঠেছে। ৬ ও ৭ নম্বর ভবনের মাঝখানের চত্বরে বিশাল ছাতার মতো অনেকগুলো কাঠ বাদাম গাছ। গাছ ভরা বাদাম। গ্রামে থাকতে বাগান থেকে কুড়িয়ে এনে দা দিয়ে ফেড়ে কত কাঠ বাদামের শাঁস খেয়েছি। এখানে কোথাও কোথাও গাছ থেকে কাঠ বাদাম পড়ে স্তুপ হয়ে আছে। কেউ নেয় না। কে নেবে এখানে সব সাহেবদের কাজ কারবার। আকাশে আষাঢ়ে মেঘের আনাগোনা। বিকেল নেমেছে। বেশ চমৎকার একটা বাতাস। ৬ নং ভবনের উপর এলোমেলো পাখি উড়ছে। সচিবালয়ে প্রতিদিন এ বিকেলটার জন্য আমি বসে থাকি। কাঁঠাল তলাটা ঘিরে আরো কি কি সব গাছ। একটি গাছ অনেব বড়। ঝাউ গাছ আছে কয়েকটা। মা ফোন করে- বাবা তুমি কই। শুনছি হরতালে শহরে গন্ডগোল হইছে। বলি- কই না তো। মা বলে- বাবা আইজ তাড়াতাড়ি আইসো।
পাশে বায়তুল মোকাররম মজজিদের মিনারটার দিকে তাকিয়ে থাকি। পাশের কাঠ বাদাম গাছে বড় একটা কাকের বাসা। সেখান থেকে কি একটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। স্টেডিয়ামের দিকে দূর আকাশে পাখির ওড়াওড়ি। কেমন যেন লাগে। কি যেন মনে হয়। কাজ ছাড়া আমার আর কোন জীবন নেই। কেউ আমার জন্য ভালবাসা পোষে না। এ কঠিন জীবন। সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় এত চাপ আমি সইতে পারছি না। অফিসে ফেরার আগে প্রতিদিন আমার এমন মনে হয়। ফের কাজের মগ্নতায় এ ভাবনার জটিলতার সুতোটি যে কখন ছিড়ে যায় তা টেরই পাই না।
- রানা মুহম্মদ মাসুদ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




