বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি জনগণের (বিহারি) সংখ্যা ৫ লক্ষ। অথচ পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি জনসংখ্যা রয়েছে ৩০ লক্ষ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তাদের নাগরিকত্ব আটকে দেয় পাকিস্তান সরকার।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পাকিস্তানে বাঙালিরা ঘৃণার শিকার হয়ে পড়ে। তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে দেখা শুরু হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঙালিরা পাকিস্তানে জন্মেছে,পাকিস্তানেই বড় হয়েছে তারপরেও বাঙালিরা পাকিস্তানে অমানবিক জীবনযাপন করছে। করাচীর নোংরা ঘিঞ্জি একটি জনপদে নোংরা পানি জমে থাকা তার ওপর ভাসছে আবর্জনা আর রাস্তার দুপাশে বস্তির মত সার সার ঘর, শুধু করাচিতেই এমন প্রায় ১০৫টি বাঙালি বস্তি রয়েছে। যে বস্তিগুলিতে দিনের মধ্যে কুড়ি ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না, পানীয় জল আসে দিনে মাত্র একবার। সিংহভাগ বাঙালির আবাসস্থল এখানেই।
তাঁদের কলোনির রাস্তায় হাঁটলে শুনতে পাবেন মমতাজের হিট গান ‘খায়রুল লো তোর লম্বা মাথার কেশ’ বা ‘ তুমি দিও নাগো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া। তাদের কাছে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, মমতাজ, অ্যান্ড্রু কিশোরের বাংলা গান জনপ্রিয়। করাচি ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় মাস্টার্স করা যায়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ানো হয় রবীন্দ্রনাথের গোরা, নজরুলের অগ্নিবীণা থেকে জসীমউদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ। পড়ানো হয় হুমায়ুন আহমেদ।
কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের চলাফেরা করতে হচ্ছে তারা যে বাঙালি সেটা গোপন করে, চলতে হচ্ছে পিতৃপরিচয় গোপন করে। বাঙালি পরিচয়ে কোন সুযোগ সুবিধা নেয়া যায় না। পাচ্ছে না নাগরিকত্ব বা কোন পরিচয়পত্র। না পাচ্ছে শিক্ষা, চাকুরি, চিকিৎসা সেবা। তারা নিজেদের মহল্লার ভিতরেই সুইপার, ঝাড়ুদার, মুচি, নাপিত, কসাই, জেলে হিসাবে কাজ করে। এই ধরনের নিম্ন মানের কাজ করে কোন রকম জীবনযাপন করছে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর শাসনামলে কিছু শীর্ষ উপদেষ্টা বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসী জনসংখ্যাকে রাষ্ট্রের জন্য ভীতিজনক আখ্যা দেন। এবং ভোটাধিকার না থাকলেও, করাচির বাঙালিরা বেশিরভাগই পাকিস্তান মুসলিম লীগের সমর্থক। যেটি বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান বিরোধী দল ছিল। যার কারণে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো অভিবাসীদের বিতাড়নবিষয়ক একটি কঠোর আদেশ জারী করে পাকিস্তান থেকে বিমানে করে বেশকিছু বাঙালিকে পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশে। যা নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের চুড়ান্ত অবনতি ঘটেছিল। বাংলাদেশ পাকিস্তানের পাঠিয়ে দেওয়া দুই বিমানভর্তি বাঙালি শরণার্থীকে নিতে অস্বীকার করে এবং দুটি বিমানকেই ফেরত পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তানে।
ইতিমধ্যে পাকিস্তান মুসলিম লিগ ও ধর্মীয় সংস্থাগুলি বেনজির ভুট্টোর এই কাজকে ইসলামবিরোধী বলে আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। ফলে বেনজির ভুট্টোকে ‘বাংলাদেশি হটাও‘ অভিযান পিছিয়ে আসতে হয়েছিল।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আসাদ ইকবাল বাট একবার বিবিসিকে বলেছিলেন বাঙালিদের মর্মান্তিক অবস্থার কথা। তিনি বলেছিলেন “একজন অবাঙালি পাকিস্তানি শ্রমিক যেখানে মাসে ১২-১৩ হাজার রুপি মজুরি পান, একজন বাঙালি শ্রমিক পান তার অর্ধেক বা আরো কম। বাঙালি মেয়েরা কারখানা এবং লোকের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে শুধু যে পয়সা কম পান তা নয়, অনবরত যৌনশোষণের শিকারও হচ্ছেন তাঁরা।“
পাকিস্তানি বাঙালিদের সংগঠন পাক মুসলিম অ্যালায়েন্স’র অধীনে বাঙালিরা নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে, ফলশ্রুতিতে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতায় এসে বলেছেন, বাঙালিদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট দেবেন। বাংলাদেশ-পাকিস্তান দুই দেশের তিক্ত সম্পর্কের কারণে এই বিষয়টি মিমাংসার জন্য কোন পক্ষ এতদিন এগিয়ে না এলেও ইমরান খানের সরকার আসার পর দুই দেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর একটি আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এই শিথিলতার মধ্যে বাংলাদেশ যদি একটু এগিয়ে আসে তাহলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে জটিল ছিটমহল সমস্যার সমাধানের মতো বাংলাদেশ-পাকিস্তানের অবহেলিত নাগরিকদের বিশাল একটি সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২০ ভোর ৫:৪৭