২০১২ সালে আমি অনার্স ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র। ক্লাস করার উদ্দেশ্যে মেস থেকে বের হলাম, পথিমধ্যে বাড়ি থেকে ফোন, আম্মা অসুস্থ, ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বাদ দিয়ে, আম্মাকে রিসিভ করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলাম। মায়ের ব্যাথা মনে হচ্ছিল প্রতি সেকেন্ড মৃত্যু যন্ত্রণা। জরুরী বিভাগে আমার মা ব্যাথায় চিৎকার করছে। সেখানে দায়িত্বরতরা বকাঝকা করে, কেন এমন চিৎকার দিচ্ছে। যে যার মতো কাজ করছে, কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই।
জরুরী বিভাগের অবস্থা এমন জানা ছিলো না। টিকেটের জন্য দাড়িয়ে আছি। কাউন্টারে ডিউটিরতদের কাজে কোন মনোযোগ নেই। মোবাইলে কথা বলছে, আরেকজনের সাথে কথা বলছে। আবার উঠে চলে যাচ্ছে, আসছে। যাক ভর্তি টিকিট টিকেট নিলাম। ভর্তি দিলো, ওয়ার্ড ১০৫ । কোন সিট তো দূরে থাক। কোন চিপা চাপায় যে রোগীকে রেখে আগে একটু দমে পানি দিবো সে ব্যবস্থাও নাই। অনেকক্ষণ অসহায় এতিমের মতো খোজাখুজি করার পর কোন কুল কিনারা পেলাম না কি করবো? এর মধ্যে একজন মহিলা পরিস্কার কর্মী এসে বলছেন, সিট হবে না জায়গা ব্যবস্থা করে দিবে ৫০০ দিতে হবে। আমরা ছিলাম অজপাড়া গাঁয়ের দরিদ্র পরিবারের, আমাদের কাছে ৫০০ টাকাই অনেক। ওই মহিলাও কমে জায়গা ব্যবস্থা করে দিবে না। এর কাছে, ওর কাছে গিয়ে বল্লাম কোন লাভ হলো না, বুঝলাম এরা এক সিন্ডিকেট। মায়ের অবস্থা খারাপ দেখে উপায়ান্তর না পেয়ে ৫০০ টাকা দিলে তারা ২য় তলায় পূর্ব দিকের একটা গলির শেষমাথায় ফ্লোরে জায়গা করে দেয়। যাক মাকে একটু শোয়ালাম। এর মধ্যে যদিও আরো চাঁদা দিতে হইছে। যাক এবার দ্রুত মায়ের চিকিৎসা করাতে হবে। ভর্তির কাগজ নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। কেউ বল্লো এই রুমে, কেউ বল্লো ওই রুমে। গুরতে গুরতে একজন বল্লো আপনি ওই রুমে যান। দরজার ওপরে লেখা বিভাগীয় চেয়ারম্যানের রুম (কোন বিভাগ, ডাক্তারের নাম অত্যধিক মানসিক চাপে খেয়াল করি নাই) যাক ওনি ২০ সেকেন্ডের মতো মনোযোগ দিয়ে ভর্তির কাগজ পত্র দেখলেন। মনে সান্ত্বনা পেলাম, মার চিকিৎসা এবার হবে। কিছুক্ষন পর উনি কাকে ডেকে আনলেন, আর বল্লেন এটা ভর্তি নিছে কেন? এটা বলে ভর্তির কাগজপত্র ঠান্ডা মাথায় কি বুঝে ছিড়ে ফেলে দিলো বুঝলাম না। ওমা আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো, কি করবো কিছু বুঝতেছি না। এই দিকে মায়ের মৃত্যু যন্ত্রণা, এই দিকে দৌড়াদৌড়ি। সারাদিন মা, আমি দুজনেই উপাস। এই দিকে ডাক্তারের কাছে যাই, কোন কথা বলে না। মায়ের যন্ত্রনা বেড়েই চলছে। হুইল চেয়ারে করে মাকে এখান থেকে ওখানে নিচ্ছি, মা যন্ত্রণায় চিৎকার করে কান্না করছে। আমার মা ছিলো সাহসী একজন নারী। কখনো মা'কে কাঁদতে দেখিনি, এই প্রথম দেখলাম। মায়ের কষ্টে আমিও হুহল চেয়ার ঠেলছি আর কাঁদছি। এইভাবে সারাদিন শেষ। পরের দিন আবার আমার বন্ধু আনিসের সাহায্য ভর্তি করালাম। এই দিন চেয়ারম্যান স্যার আসেনি হাসপাতালে। আরেকজন ডাক্তার রাউন্ড দিচ্ছেন। আমি কাগজপত্র নিয়ে ওনার কাছে বলছি, স্যার আমার মায়ের অবস্থা খারাপ, একটু দেখেন না প্লিজ। ওনি একবারের জায়গা ২ বার বল্লাম কেন কাগজপত্র রেগে ছুড়ে পেলে দিলেন। কারন ভর্তি ওনার অধিনে না। কিছুক্ষণ পর আরেকজন ডাক্তার নাকি ইন্টার্নি জানি না। উনি আমার মুখে শুনে আপাতত ২ টা ব্যাথার ইনজেকশন লিখে দিলো। আমি বাহির থেকে কিনে এনে এই দুইটা ইনজেকশন দিলাম। আর বল্লো MRI করে নিয়ে আসতে। MRI করতে গেলাম বল্লো ওটা সকালে সিরিয়াল দিতে হয়। যাক MRI করাতে হবে আশায় ওই দিন শেষ করলাম। পরের দিন সকালে গিয়ে দেখি সিরিয়াল শেষ। দিনে মাত্র ৫/৬ টা MRI করা হয়। ভাবলাম আগামীকাল ভোরে এসে সিরিয়াল দিবো আর MRI করে ডাক্তারকেও দেখাবো। পরের দিন সকালে এসে ৩ নাম্বার সিরিয়াল দিলাম। ১ জনের MRI করার পরই বল্লো আজকে আর MRI করা হবে না, মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ছি। কি করবো, কি সিদ্ধান্ত নিবো মাথা কাজ করছে না
পুরো হাসপাতালটাই এলোমেলো, কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা নেই। ডাক্তার আসলে আসলো, না আসলে নাই। ডাক্তারের পরিবর্তে ওয়ার্ড বয়, আয়ারা অপারেশন, ড্রেসিং, ইনজেকশন দেয়া এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। পাশে কোন রুগীর স্বজনরা চিল্লাচিল্লি করছে, তাদের রুগীর নাকি বাপ পাশের কিডনি অপারেশন করার কথা কিন্তু তা না করে ডান পাশের কিডনি অপারেশন করছে! হাসপাতালের বাথরুম সম্পূর্ন ব্যবহার অনুপযোগী। মানুষ পায়খানা করতে করতে ময়লা উপর পর্যন্ত হয়ে গেছে। এর উপর পলিথিন ভরা আবর্জনা, পিরিয়ডের প্যাড সহ হাবিজাবি ময়লায় পুরো বাথরুম স্তুুপে পরিনত হয়েছে। চিন্তা করলাম এগুলো কি কেউ দেখার নাই। এই হাসপাতাল পরিচালনা করে কে? কোন সাংবাদিক আসে না? এখানে এসেও কি হবে? কয়টা নিউজ করবে? আমার স্যার বলতো- সর্বাঙ্গে ব্যাথা, ঔষধ দিবো কোথা?
যাক এখন এসব চিন্তা করার সময়ও আমার নাই, আমার মা'কে চিকিৎসা করাতে হবে। তারমানে আজকেও MRI হলো না। কিন্তু আজকে চেয়ারম্যান স্যার আসেন। ওনার কাছে গেলাম, উনি যথারীতি আগের মতো ভর্তি কাগজ চিড়ে ফেলে দিলেন, সাথে একজন ওয়ার্ড বয়কেও বকাঝকা করলেন। কেন আবার ভর্তি হয়েছি এজন্য। দেখলাম এখানে তো চিকিৎসা হচ্ছে না, বল্লাম স্যার আমার মা'কে কি করবো? উনি বল্লো এই রুগী ভর্তি করা যাবে না। মা'কে আমি এখন কোথায় নিয়ে যাবো, কি করবো? কিছু বুঝতে পারছি না। উপায়ন্তর না দেখে আমি বল্লাম তাহলে আমার মা'কে নিয়ে যাবো? উনি বল্লো, হ্যাঁ নিয়ে যাও।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০৭